১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ । সকাল ৬:৪৬ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
মোঃ হাসানুজ্জামান:
সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার নেতিবাচক প্রভাবে পড়েছে অধিকাংশ দেশেই। প্রভাব থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। এমনকি আক্রান্ত হয়েছে বাংলাদেশের বিদায়ি অর্থবছরের মুদ্রানীতিও। মন্দার প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করে উৎপাদনমুখী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি টাকার প্রবাহ কমিয়েও মূল্যস্ফীতির হারে নিয়ন্ত্রণ আনা যায়নি। রিজার্ভের ক্ষয় রোধ করাও সম্ভব হয়নি। সবমিলিয়ে বলাই যায়, যে টার্গেট নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
তবে আশা হারালে চলবে না। বিরূপ প্রভাব থাকলেও রেমিট্যান্স প্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বেড়েছে। মুদ্রানীতির এমন প্রধান ১১টি লক্ষ্যের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে মাত্র ২ টির। বাকি ৯টির লক্ষ্যই আলোর মুখ দেখেনি। তবে আগের তুলনায় অর্থনৈতিক মন্দার তীব্রতা কমেছে। মন্দার ক্ষত বেড়েছে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন তথ্যই পাওয়া যায়।
নতুন মুদ্রানীতিঃ
একটি সূত্র জানায়, মুদ্রানীতির এমন অবস্থার মধ্য দিয়েই এ মাসের শেষ দিকে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। বিদায়ি অর্থবছরের মতো এবারও মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে এবার বিলাসী খাতে ঋণের প্রবাহ অনেকটা কমিয়ে উৎপাদন খাতে বাড়ানো হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যঃ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত জুন পর্যন্ত বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। মে পর্যন্ত সাময়িক হিসাবে বেড়েছে ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। টাকার প্রবাহ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কমিয়েও মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি।
বিনিয়োগে অনাগ্রহঃ
সমীকরণ বলছে, টাকার প্রবাহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক যতটুকু না কমিয়েছে তারচেয়ে বেশি কমেছে উদ্যোক্তাদের চাহিদা না থাকার কারণে। ডলার সংকট ও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কেউ এখন বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে ঋণের চাহিদাও বাড়েনি। চাহিদা না বাড়ায় ঋণের জোগানও বাড়াতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। টাকার প্রবাহ কমার আরও একটি বড় কারণ সরকারি ঋণে লাগাম।
মূল্যস্ফীতির হারঃ
বাজেট অনুযায়ী সরকার গত জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৭ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এর সমর্থনে মুদ্রানীতি সাজিয়েছিল। মে পর্যন্ত এ হার না কমে বরং আরও বেড়ে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়। এই সময়ে খাদ্য পণ্যেও দাম বেশি বাড়ায় এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভঃ
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জুনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধির কথা ছিল। ওই সময়ে রিজার্ভ তো বাড়েইনি, উলটো ক্ষয় হয়েছে। জুনের শেষে গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৭৭ কোটি ডলার। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬৭৭ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে এখন ব্যয় মিটিয়ে কিছু উদ্বৃত্তও থাকছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ডলার উদ্বৃত্ত হচ্ছে।
ডলারের উপর বাড়তি চাপঃ
তথ্য ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী আগের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে এখন ডলারের ওপর পড়েছে বাড়তি চাপ। এতে বৈদেশিক মুদ্রার আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এ কারণে সার্বিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যালেন্সেও ঘাটতি হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক ব্যালেন্সে ঘাটতি গত জুনের মধ্যে ৬০ কোটি ডলারের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এপ্রিল পর্যন্ত এ ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার।
রপ্তানি আয়ে জটিলতাঃ
নেতিবাচক প্রভাবসমূহ,লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া সহ নানা কারণে এখন বড় জটিলতা দেখা দিয়েছে রপ্তানি আয়ে। যেসব পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে তার মধ্যে অনেক আয় দেশে আসছে না। পণ্য রপ্তানির ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে আয় দেশে আনার কথা। কিন্তু বৈশ্বিক মন্দার কারণে উদ্যোক্তারা সেগুলো দেশে আনতে পারছেন না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানি আয় দেশে আনার সময়সীমা বাড়িয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেশে না আসা রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ১৫০ কোটি ডলার। জুন পর্যন্ত রপ্তানি আয় বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ শতাংশ। ওই সময়ে রপ্তানি আয় বাড়েনি। বরং গড়ে কমেছে দশমিক ৫০ শতাংশ।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধিঃ
শুরুতে বৈশ্বিক মন্দার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহে সতর্কতামূলক প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু বছর শেষে রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কয়েকটি দেশে হুন্ডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩ শতাংশের কম বাড়বে। ২০২৩ সালে বেড়েছিল ৩ শতাংশ। ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন করেও প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোতে উৎসাহিত করা যাচ্ছে না।
আমদানিতে সমস্যাঃ
সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ডলার সংকটের কারণে আমদানি এখনো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে আমদানি নির্ভর শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত জুন পর্যন্ত আমদানি ৭ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এপ্রিল পর্যন্ত কমেছে ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। আমদানি কমায় এ খাতের শিল্পে নেতিবাচক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। সংগত কারণেই আমদানিনির্ভর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
সরকারি ঋণ প্রবাহঃ
এদিকে সরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ জুন পর্যন্ত ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মে পর্যন্ত বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। তবে জুনের শেষ দিকে সরকারের ঋণ আরও বেড়েছে। সরকারের ঋণ কমায় সার্বিকভাবে বাজারে হ্রাস পেয়েছে টাকার প্রবাহ।
বেসরকারি ঋণ প্রবাহঃ
আর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ শতাংশ। মে পর্যন্ত বেড়েছে ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ। বেসরকারি খাতের নতুন ঋণ বিতরণ হয়েছে কম। বরং আগের ঋণের সঙ্গে সুদ যোগ হয়ে ঋণের স্থিতি বেড়েছে। যা সমীকরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আমদানি-রপ্তানি ব্যালেন্সঃ
মূলত আমদানি ব্যয় কমিয়ে ও রপ্তানি আয় বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। গত জুনের মধ্যে তা কমিয়ে ১ হাজার ২০ কোটি ডলারে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এপ্রিল পর্যন্ত ঘাটতি হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। তবে ঘাটতি আগের চেয়ে কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি ছিল দেড় হাজার কোটি ডলারের বেশি।
সুদের হার বৃদ্ধিঃ
বিদায়ি অর্থবছরের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় সুদের হার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। মুদ্রানীতি এ খাতে সফল। সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এতে টাকার প্রবাহ কমেছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমেনি। বলা হয়েছিল সুদের হার বাড়লে টাকার প্রবাহ কমবে। তখন মূল্যস্ফীতিও কমে যাবে।
বিশ্লেষকদের মতঃ
বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে অনেকেই মনে করেন; ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের বহিঃঅর্থনীতি নিয়ে টানাপড়েনের কারণে আমদানি কমেছে। তাই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি বহিঃঅর্থনীতির সংকটের কারণে মোটা দাগে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে এসেছে। ফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতেও। দেশে রাজস্ব ব্যবস্থার প্রসার না ঘটলে সরকারের আয় বাড়ানোর সুযোগ কম। একইভাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার এবং চলতি বাজারমূল্যে জিডিপির আকার বাড়ানো না গেলে ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিতে সেই সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব উদ্যোগেও আসবে না গতি। এই বাস্তবতায় প্রতিবছরই বাজেটীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ জিডিপি, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, ভোগ ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, সঞ্চয়, ব্যাংক আমানত, এবং সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সরকারকে যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ রাখতে হবে। সেইসাথে দেশের আমদানি-রপ্তানির মাঝে সমতা রক্ষা করা, ব্যাংক ব্যবস্থা পুনর্গঠন সহ শক্ত হাতে পরিচালনা করার কোনো বিকল্প নেই। তাহলেই একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরের মুদ্রানীতি অনেকটাই আলোর মুখ দেখবে।
Leave a Reply