৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । বিকাল ৫:৩৫ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
ব্যাংকিংখাতে এখনো সক্রিয় এস আলম গ্রুপ
স্টাফ রিপোর্টার :
ব্যাংকিংখাতে লুটপাটের মাফিয়া বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ এখনো সক্রিয় রয়েছে। গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনিয়ন ব্যাংকে দুর্নীতির সহযোগী হাবিবুর রহমানকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি পদে নিয়োগের তৎপরতা শুরু হয়েছে। ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের মামলায় চার্জশীট ভুক্ত আসামি হাবিবুর রহমান। যিনি এস আলম গ্রুপের ডুবতে থাকা ইউনিয়ন ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি)।এছাড়া দুর্নীতির দায়ে মহামান্য হাই কোর্টের আদেশে তিনি সর্বশেষ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ থেকেও পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাংকটির এমডি পদে তাকেই আবার ফিরিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকে এস আলম পন্থী হিসাবে পরিচিত বেশ কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তা ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের ওপর তীব্র চাপ প্রয়োগ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মহলের চাপ ও প্ররোচনায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গত ৫ সেপ্টেম্বরের বোর্ড সভায় তাকে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়। সোমবার এ সংক্রান্ত একটি চিঠি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক থেকে অনুমোদনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। উল্লেখ, এর আগে গত ৬ মে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য করা আবেদন নিষ্পত্তি করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওই নির্দেশনায় তখন আগামী ৬০ দিনের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছিল। আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রিটকারীর আইনজীবী মো. বেল্লাল হোসেইন শাহীন ও আবু তালেব জ্যাকব। তাঁরা জানান, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের একজন গ্রাহকের করা রিটের শুনানি শেষে ব্যাংকের এমডি ও সিইও হাবিবুর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন নিষ্পত্তিতে এই আদেশ দেন আদালত। কিন্তু আদালতের আদেশ নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই বিতর্কিত ও পদত্যাগী এমডিকে আবার স্বপদে ফিরিয়ে আবার অপচেষ্টা চলছে।
জানা গেছে, চাকরি জীবনে হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আর্থিক
কেলেঙ্কারির ঘটনা শুরু হয় মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে। এ ঘটনায়
১১ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মতিঝিল থানায় করা দুদকের মামলায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের তৎকালীন এমডি মো. হাবিবুর রহমানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। বর্তমানে তিনি এ মামলায় জামিনে রয়েছেন। মতিঝিল থানার দন্ডবিধি ৪০৬/৪০৯/৪২০/১০৯ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং জিআর ৯৭/২০১৮। যাহা বর্তমানে মেট্টো স্পেশাল মামলা নং ২৭২/২২ হিসেবে চলমান রয়েছে। পরবর্তীতে হাবিবুর রহমান বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রনাধীন ইউনিয়ন ব্যাংকে ২০২১ সালে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা হিসাবে যোগ দিলে সেখানেও ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তিনি বিতর্কিত হউন বলে অভিযোগ রয়েছে। দুইবছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালে ইউনিয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা বেশির ভাগ ঋণে বড় ধরনের অনিয়ম খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু ট্রেড
লাইসেন্সের ভিত্তিতে কোম্পানি গঠন করে ঋণের বড় অংশই বের করে নিয়েছে প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্সও ছিল না। কাগুজে এসব কোম্পানিকে দেওয়া ঋণের বেশির ভাগেরই খোঁজ পাওয়া যায়নি। ফলে এসব ঋণ আদায়ও হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ১৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা খেলাপি হওয়ার যোগ্য, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটির সিংহভাগই খেলাপি বা অনিয়মের ঋণে পরিণত হয়েছে। এ অনিয়মের ঘটনায় ইউনিয়ন ব্যাংকের সেই সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাম্মেল হক চৌধুরী ও ব্যাংকটির সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিবুর রহমান সরাসরি জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ দুজনেই এস আলমের অপকর্ম ও দুর্নীতির ঘনিষ্ঠ সহযোগী সহযোগী হিসাবে পরিচিত। এসব অনিয়মের বিষয়ে সেই সময় ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একটি চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সতর্কও করা হয়েছিল। এ বিষয়ে ওই সময় হাবিবুর রহমানকে তার কার্যালয়ে
সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে কৌশলে
পালিয়ে যান। এছাড়াও তিনি একই দায়িত্বে থাকাকালে এস আলমের ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় সংলগ্ন শাখার ভল্ট হতে ১৯ কোটি টাকা লোপাটের-ও ঘটনা ঘটে যা সেই সময়ে আলোচনার জন্ম দেয়।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি হাবিবুর রহমান জানান, তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলা এবং ঋণ বিতরণে যেসব অনিয়মের কথা বলা হচ্ছে তা সবই ষড়যন্ত্রের অংশ। তিনি বলেন, কখনো কোন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না, ভবিষ্যতেও থাকবো না। একটি বিশেষ মহল বরাবরই তার বিরুদ্ধে কাজ করছে। দুদকের মামলা বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি আইনগত ভাবেই মোকাবেলা করা হবে। তিনি ন্যায় বিচার পাবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, ব্যাংকিংখাতে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপযুক্ত, পেশাগতভাবে দক্ষ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিই এমডি হতে পারবেন। তবে ফৌজদারি আদালতে দন্ডিত কিংবা জাল জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্যান্য অবৈধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি ব্যাংকের এমডি হতে পারবেন না। এছাড়া অর্থ আত্মসাৎ, দুর্নীতি, জাল জালিয়াতি ও নৈতিক স্খলনের মতো ঘটনায় জড়িত থাকলে তিনি এ পদের যোগ্য হবেন না। আইন
বিশেষজ্ঞরাও মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ করলেই হাবিবুর রহমান পুনরায় আর এমডি হিসাবে নিয়োগ পেতে পারেন না। বর্তমান তার বিরুদ্ধে দুদকের যে মামলা চলমান রয়েছে তাতে তিনি নৈতিকভাবেই এ পদে আর থাকতে পারেন না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক কারণে গত সরকারের সময় যারা বঞ্চিত হয়েছেন তাদের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার সহানুভূতিশীল, কিন্তু ব্যক্তিগত দুর্নীতির কারণে কেউ যদি সুবিধা বঞ্চিত হয়ে থাকে তাকে সেই সুবিধা ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তমান সরকার নেয়নি। বরং যারা দুর্নীতিবাজ ও আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেত্বত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালাহউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বলে আসছেন, আর্থিকখাতের কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। বিশেষ করে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকিংখাতে লুটপাট ও অর্থ পাচারকারিরা আইনের আওতায় আসবেন। এদিকে, এস আলমের সহযোগী হাবিবুর রহমানকে পুনরায় এমডি হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় অস্থিরতা বিরাজ করছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে। ব্যাংকটির কর্মকর্তারা বলেন, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের একজন গ্রাহক কর্তৃক এইরূপ একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে এমডি পদে না রাখার আবেদন হাইকোর্টে করা হলে মহামান্য হাইকোর্ট তার বিষয়ে তিন মাসের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে আদেশ প্রদান করেন। যার ফলশ্রুতিতে হাবিবুর রহমান স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক হতে পদত্যাগ করেন। এখন মহামান্য আদালতের নির্দেশনা মেনেই এমডি নিয়োগের বিষয়টির সমাধান হওয়া উচিত। জানা গেছে, দেশের প্রায় সকল ইসলামী ব্যাংক যখন এস আলম গ্রুপের লুটপাটের কারণে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে রয়েছে। হাতে গোনা দু-একটি ইসলামী ব্যাংক এখনো আছে যেখানে এস আলম লুট করতে পারেনি। কিন্তু এস আলমের সহযোগী হাবিবুর রহমান স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগ পেলে এই ব্যাংকটিও ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে গত ২৮ এপ্রিল দুদকের মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। তবে প্রাথমিক তদন্তে হাবিবুর রহমান এর যোগসাজশ গোচরীভূত না হওয়ায় মামলার এজাহারে (FIR) আসামি হিসেবে তার নাম উল্লেখিত ছিল না। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে এফআইআরে এ অন্তর্ভুক্ত কয়েকজনের অপরাধের সাথে কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি, বরং হাবিবুর রহমান কিভাবে প্রতারণামূলক ভাবে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে খারাপ ঋণ সৃষ্টি করেছেন তার সুস্পষ্ট প্রমান পাওয়া যায়। অধিকন্তু মঞ্জুরিপত্র ব্যতিত কোনো ঋণ প্রদান করা হলে সেটি কোনো বৈধ ঋণ হিসেবে স্বীকৃত হয় না। হাবিবুর রহমান জেনেশুনে যে ঋণের কোনো মঞ্জুরিপত্র নেই, অর্থাৎ অবৈধ ঋণ, সেই ঋণ পুনঃ তফসিল করার জন্য সুপারিশ করেছেন তার ও স্পষ্ট দলিল পাওয়া যায়। এই কারণে ২০২৩ সনের জানুয়ারির ১৮ তারিখে দাখিলকৃত চার্জশীট এ এজাহারে বর্ণিত কিছু আসামির নাম বাদ পরে এবং পুর্নাংঙ্গ তদন্তে সুস্পষ্ট দালিলিক প্রমাণ পাওয়ার কারণে হাবিবুর রহমানের নাম যুক্ত হয়। মামলার চার্জশিট থেকে জানা যায়, এই মামলার অন্যতম আসামি হাবিবুর রহমান ২০০০-২০০৩ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় ব্যাংকের গ্রাহক প্যাট্রিক ফ্যাশনস লিমিটেডের নামে ঋণ প্রস্তাবের সুপারিশ করেন এবং পরবর্তীতে পুনঃতফসিলের সুপারিশ করেন। তিনি উক্ত ব্যাংকের ক্রেডিট ডিভিশনের তৎকালীন ইনচার্জ হিসেবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির সভায় প্যাট্রিক ফ্যাশনসের সিআইবি রিপোর্ট সম্পর্কিত অসত্য তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করান।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি না পাওয়ায় উক্ত ঋণ প্রস্তাবের মঞ্জুরিপত্র ইস্যু করেনি মার্কেন্টাইল ব্যাংক। মঞ্জুরিপত্র ছাড়াই কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে ওই প্রতিষ্ঠানকে ৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ঋণ দেন হাবিবুর রহমান। পরবর্তীতে তিনি ওই ঋণ পুনঃতফসিলের জন্যও সুপারিশ করেন। ঋণের সুদ বাবদ ৩ কোটি ৭১ লাখ ৩ হাজার টাকা ক্ষতিতগ্রস্ত হয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। ওই ঋণ আত্মসাতের ঘটনায় সব মিলিয়ে ১১ কোটি টাকা হারিয়েছে ব্যাংকটি। ঘটনার সময় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ক্রেডিট ডিভিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্টের (এভিপি) দায়িত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান।
এই ঘটনা প্রকাশে আসলে ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে হাবিবুর রহমান সহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করেন।
##
Leave a Reply