১১ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । সকাল ১১:২৮ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
হাসি ইকবালঃ
বাংলাদেশে বেশির ভাগ বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল চলছে খেয়াল খুশি মতো। না আছে পর্যাপ্ত ডাক্তার, না আছে পাশ করা নার্স, না আছে দক্ষ আয়া, পিয়ন। অথচ ব্যাঙের ছাতার মতো প্রশাসনের নাকের ডগায় ঝুলে প্রতিনিয়ত গজে উঠছে নতুন নতুন ক্লিনিক ও হাসপাতাল। টাকা ইনভেস্ট করে পটপট করে ভাগ্যের পটপরিবর্তন করার উত্তম পেশা এখন বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল বিজনেস।
বলাবাহুল্য, শিশুদের উত্তম চিকিৎসা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঢাকার শ্যামলীতে বাংলাদেশের একমাত্র শিশু হাসপাতালটিও এখন অনেকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে।
চিকিৎসকদের খাম-খেয়ালি, নার্সদের খবরদারি, আয়া, পিয়ন, প্রশাসনিক ও অন্যান্য কর্মচারী, কর্মকর্তা, সর্বপরি আনসার এবং বহিরাগত দালালদের দৌরাত্ম্যে হাসপাতালটি নিজেই আজ লাইফ সার্পোটে।
প্রসঙ্গত, গতকাল রাত বারোটায় ভাগ্নীর একমাত্র সন্তানকে গুলশান মা ও শিশু ক্লিনিক, নর্দা থেকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করিয়েছি। সেখানে গিয়ে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো –
প্রথমত, ইমারজেন্সী ইউনিটে শতশত শিশুর জন্য রয়েছেন, মাত্র একজন ডাক্তার। তার পক্ষে এত গুরুতর শিশু রোগী সামাল দেয়াটা রীতিমতো ছিল যুদ্ধের মতো । পরবর্তীতে অবশ্য আরেকজন সদ্য পাশ করা ডাক্তার আসেন। কিন্তু রোগী দেখার পাশাপাশি তাকেও ডিরেকশন দিতে হতো ডিউটিরত ডাক্তারকে। ডিউটিরত ডাক্তার তপন আন্তরিক হলেও শতশত রোগী একাই অবজার্ভ ও চিকিৎসাপত্র দেয়াটা রীতিমতো তার জন্য কষ্টকর ছিল। ইমারজেন্সিতেই দাড়িয়ে থাকা অবস্থায় আমার চোখের সামনে তিনটি অবুঝ প্রাণ ঝরে গেল। দাড়িয়ে দাড়িয়ে সে দৃশ্য আর চোখের সামনে বাবা মায়ের বুক খালি করা কান্না দেখে পাথর হয়ে থাকা ছাড়া আমার পক্ষে কিছুই করা ছিলনা।
বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ভাগ্নীর ১৫ মাস বয়সী শিশু কন্যা “ইউসা” কে ডাক্তার তপনের সহায়তায় আইসোলেসনে ভর্তি করানো হলো। কিন্তু বাচ্চার মা গুলশান মা ও শিশু হাসপাতালে কয়েকদিন তার শিশু কন্যাকে নিয়ে ভর্তি থেকে অসুস্থ হওয়ার তার পক্ষে একাই বাচ্চা সামাল দেয়া মুসকিল ছিল। কর্তব্যরত নার্স কিছুতেই তাকে ছাড়া আর কোন এটেনডেন্ট এলাউ করবেন না। তাকে অনেক বোঝানো হলো যে আমরা পেশেন্টকে শিফট করাই দিয়েই বাইরে চলে যাবো। নার্সের ব্যবহার এতটাই খারাপ যে, তার সাথে কথা বলতে গেলে মুখ খারাপ করতে হয়। অগত্যা রোগী ঐ অবস্থায় রেখেই আমি বাইরে বেড়িয়ে এলাম।
আইসোলেশন থেকে বেড়িয়েই চোখে পড়লো, তিন বছর বয়সের এক শিশু কন্যার মৃত্যুর আহাজারি। বাবা মা আত্মীয় স্বজন তাদের কলিজার টুকরার লাশ বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল ত্যাগ করছে। তাদের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জানতে পারলাম, শিশুটি ক্যান্সার আক্রান্ত ছিল। যাই হোক, যে কথা বলতে চেয়েছিলাম –
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এই অভিযানে ছোট বড় সব ধরনের হাসপাতালেই নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতের দৈন্যদশা, দুর্নীতি ও মানবতাবিবর্জিত কার্যকলাপের কারণে আমরা জনসাধারণ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা-সেবা নিতে গিয়ে প্রতিদিন নানা হয়রানি ও সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। এ সংক্রান্ত খবর কিছুটা হলেও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এসব খবরের কোনো কোনোটি মানুষকে এমনভাবে নাড়া দেয়, যা ভাষায় প্রকাশ করতে কষ্ট হয়। কিন্তু এর সুরাহা হচ্ছে কই?
বলার অপেক্ষা রাখেনা, দরিদ্র, হতদরিদ্র, মধ্যবিত্ত মানুষকে চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন দারস্থ হতে হয় সরকারি হাসপাতালে। একটি সরকারি হাসপাতালে গেলেই বোঝা যায় একজন মানুষের প্রকৃত কষ্টের চিত্র। কতটা কাঠফোড় পুরিয়ে একজন অসুস্থ মানুষের এটেনডেনকে একটা সোনার হরিণ নামের সিট ম্যানেজ করতে হয় তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। আর গরীব হলে তো কথাই নেই, তার জায়গা হাসপাতালে মেঝেতে, নয়তো বারান্দায়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ফ্রী বেডেটা পেয়ে যেতে পারে কোনভাবে।
এদেশের ১০% মানুষের সৌভাগ্য হয়ে উঠে না বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার। যাও বা দুই একটা বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়ে উঠে সেগুলো নাম নামসর্বস্ব। ঐসব ক্লিনিক কিংবা হাসপাতাল নিজেই ক্যনুলা নিয়ে দুই বেলা স্যলাইন আর ও- স্যালাইন দিয়ে কোন রকম বেচে আছে। আর মান সম্মত হাসপাতালের কথা বলছেন, ঐ অর্থে সেটারও দেখা মেলা ভার।
দেশের নামকরা হাসপাতাল খ্যাত তৎকালীন এ্যাপোলো বর্তমান এভার কেয়ার হাসপাতালে আমারই ভূল চিকিৎসা হয়েছিল ২০১২ সালে। তখন আমার একমাত্র সন্তানের ব্রেস্ট ফিডিং চলছিলো। ভারতীয় এক ডাক্তার বলছিলেন, আমার দুইটা কিডনি ড্যামেজ। সামান্য এক ইউরিন ইনফেকশন নিয়ে গিয়েছিলাম। পরবর্তীতে বিভিন্ন হাসপাতাল, এমনকি ভারতের কিছু স্বনামধন্য হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে করাতে আমি নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। তারচেয়েও বড় কথা মানসিক ও শারীরিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল আমার পুরো পরিবার। সম্প্রতী, একই ভূল চিকিৎসার স্বীকার হলেন, এ দেশের স্বনামধন্য চিত্র অভিনেতা – মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা। যিনি এভার কেয়ার হাসপাতালে চোখের চিকিৎসার নিতে গিয়ে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার সম্মুখীন হয়ে বর্তমানে সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে আছেন। এই হলো, দেশের বড় বড় কিংবা আপনার আমার চোখে নামকরা হাসপাতালের চিত্র!
মূলত, ব্যক্তি মালিকানায় বা বেসরকারিভাবে পরিচালিত হাসপাতাল-ক্লিনিক বা ডায়গনেস্টিক সেন্টারগুলোতে সেবার মানসিকতার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে মূলত ব্যবসায়িক চিন্তা। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সব পর্যায়েই ব্যয় অনেক বেশি এবং আইসিইউতে কোন রোগীকে যেতে হলে গুণতে হয় অনেক বেশি টাকা।
সেখানে অনেক সময় পুরো টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত মৃতদেহ ছাড়া হয় না এবং এমনকি রোগী সুস্থ হওয়ার পরও আইসিইউ থেকে ছাড়া পায় না -এ ধরনের নানা অভিযোগ বিভিন্ন সময় ওঠে।
সরকারি হাসপাতালগুলোর ব্যাপারে সরকারের নতুন কোন উদ্যোগ নেই। সেকারণে স্বাস্থ্যখাত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের দখলে চলে গেছে।
এদিকে, সরকারি খাতটাকে এখন আর উন্নত করার চেষ্টাই করা হচ্ছে না। বড় বড় হাসপাতাল হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সিস্টেম অনুযায়ী উন্নত করা হচ্ছে না। সে কারণে প্রাইভেট খাতের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে মানুষ। জমিজমা বিক্রি করে হলেও মানুষ প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে।
লজ্জার সাথে বলতে হচ্ছে – এ দেশের সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পরিকল্পনার অভাব, অদক্ষতা, অস্বচ্ছতা, দীর্ঘদিন ধরে কাজে ফাঁকি দেওয়ার সংস্কৃতি, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও উপযুক্ত প্রণোদনার ঘাটতি, উপেক্ষা, খামখেয়ালিপনা ইত্যাদির খেসারত দিতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠিকে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য–ব্যবস্থা এমনিতেই অজস্র রোগব্যাধির চাপে ভঙ্গুর। তার উপর দুর্নীতি-লুটপাট আর অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায় আকণ্ঠ ডুবে আছে দেশের স্বাস্থ্য খাত।
রাজধানী থেকে শুরু করে নিভৃত পল্লী পর্যন্ত সর্বত্রই অভিন্ন অবস্থা। চিকিৎসকের বদলে নার্স, ওয়ার্ডবয়, আয়াসহ দালালরা নানা কায়দা-কৌশলে অসহায় রোগীদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিচ্ছে অর্থ। এসব দেখভালের যেন কেউ নেই। সরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন আসা শত শত রোগী চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চরমভাবে। ধনিক শ্রেণির মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য চলে যাচ্ছে বিদেশে। আর সাধারণ মানুষ ধুঁকে ধুঁকে রোগ পুষে শেষমেশ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসাসেবার করুণ অবস্থার জন্য স্বাস্থ্য খাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও সেবাহীন বাণিজ্যিক মানসিকতাকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
অসততা তো সব ক্ষেত্রেই রয়েছে। এমন একটা আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে আদৌ কি স্বাস্থ্য-দুর্নীতির অতিরিক্ত কোনও প্রভাব পড়ে?
অবশ্যই পড়ে। বললাম না, অন্য যে কোনও পেশার দুর্নীতির সঙ্গে চিকিৎসা-দুর্নীতিকে এক সারিতে বসানো ঠিক নয়। একজন অসুস্থ, রোগগ্রস্ত মানুষ তো শুধু ভরসাই করেন না ডাক্তারের উপর, নিজেকে তিনি পুরোপুরি সঁপে দেন চিকিৎসকের কাছে। ঠিক হোক বা ভুল, চিকিৎসকের যে কোনও সিদ্ধান্তই তো রোগী-পরিজন শিরোধার্য করে নেন। তাই না? চিকিৎসক যদি ব্যবসায়িক কারণে এই অসহায়তার সুযোগ নেন, তা হলে এর চেয়ে ঘৃণ্য ও নৃশংস কিছু হতে পারে না। এই অবিশ্বাস সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও বেঁচে থাকার সুস্থ পরিবেশটার বারোটা বাজিয়ে দেয়। প্রভাবিত হয় অন্য পেশার নৈতিক বাতাবরণও।
আশা করছি, প্রশাসনসহ, সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারটা মাথায় নিবেন৷ আমরা আর পারছি না। সত্যিই না। এভাবে জিম্মি থাকাটা সত্যিই কষ্টকর এবং লজ্জাজনক —
হাসি ইকবাল
নাট্যকার, কবি ও কলামিস্ট
এক্সিকিউটিভ মেম্বার, টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ
hasiiqbal39@gmail.com
( দুঃখিত, মনের কষ্টে এক নিঃস্বাসে লিখলাম মোবাইলে। কারন আপাততঃ আরো একমাস ল্যাপটপ ধরা নিষেধ। বানান ও ভাষাগত সমস্যা পরে ঠিক করে দিবো)
Leave a Reply