২৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ । রাত ৮:১৬ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
চট্টগ্রাম অফিস॥
পিকে হালদারের একান্ত সহযোগি চট্টগ্রামের খুলশীর মেয়ে নাহিদা রুনাই। বাবা মফিজুর রহমান সরকারি অফিসের ক্লার্ক ছিলেন। সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া রুনাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরির খোঁজে আসেন ঢাকায়। পেয়ে যান অফিস এক্সিকিউটিভের চাকরি। কিন্তু এই চাকরি যে কপাল খুলে দিতে পারে, রাতারাতি বানাতে পারে শতকোটিপতি- তা নাহিদা রুনাইকে না দেখলে কারও বিশ্বাসই হবে না।
তবে কপাল খোলার পেছনে আলাদিনের চেরাগ, গুপ্তধন বা লটারি পেতে হয়নি নাহিদা রুনাইকে। ফর্সা, স্মার্ট নাহিদা রুনাই জীবনের প্রথম অফিস এক্সিকিউটিভ পদে যে চাকরিটি পেয়েছিলেন- সেই অফিসটি ছিল আর্থিক খাতের কেলেঙ্কারির হোতা ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতে জড়িত পিকে হালদারের। আর চাকরির কয়েক মাসের মাথায়ই রুনাই হয়ে যান পিকে হালদারের বান্ধবী, ছায়াসঙ্গী। তার আশীর্বাদেই রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান নাহিদা রুনাই।
রুনাইর দুর্নীতি ও অর্থপাচারের মামলাসংশ্লিষ্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে এমনভাবেই রুনাইর উত্থানের কাহিনি বর্ণনা করেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, পিকে হালদার ব্যাংক খাত থেকে টাকা হাতানো বা পাচারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারের ওপর মহলকে ম্যানেজ করতেন নাহিদা রুনাই। প্রয়োজনে ওই কর্মকর্তাদের নিয়ে দেশের নামিদামি ক্লাব-রিসোর্টে বা দেশের বাইরে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতে প্রমোদ ভ্রমণেও পাঠানো হতো রুনাইকে। মোট কথা পিকে হালদারের অর্থ পাচারের বিষয়গুলো দেখভাল করতেন তিনি।
এসব কাজের পুরস্কার হিসেবে নাহিদাকে শূন্য থেকে কোটিপতি বানিয়েছেন পিকে হালদার। দুদকের অনুসন্ধান দল রুনাইয়ের প্রায় ২৮ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। এছাড়া তার ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৭০ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে। এর বাইরে তার আরও গোপন সম্পদ রয়েছে বলে ধারণা তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
পিকে হালদারের অর্থ পাচার ও আত্মসাৎ সংক্রান্ত মামলাগুলোর মধ্যে ১২ মামলার আসামি এই নাহিদা রুনাই। এসব মামলায় গ্রেপ্তারের পর তিনি এখন কাশিমপুর মহিলা কারাগারে রয়েছেন বলে কারা কর্তৃপক্ষ ঢাকা টাইমসকে নিশ্চিত করেছে।
তবে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি মামলায় রুনাই জামিন পান। গত ৮ জুলাই তার জামিন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করে দুদক। পরে আদালত রুনাইর জামিন স্থগিত করে।
দুদক সূত্রে আরও জানা গেছে, নাহিদা রুনাই ছাড়াও পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলেন অবন্তিকা বড়াল। অবন্তিকাকে গ্রেপ্তারের পর কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। তিনিও কাশিমপুর মহিলা কারাগারে ছিলেন। তবে কারাকর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সম্প্রতি অবন্তিকাকে কাশিমপুর থেকে মুন্সীগঞ্জ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে।
অবন্তিকার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নাহিদা রুনাইসহ অন্য যারা পিকে হালদারকে অর্থপাচারে সহযোগিতা করেছেন, তাদের নাম ও ঘটনার বর্ণনা উঠে এসেছে বলে দুদক কর্মকর্তারা জানান।
সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বলেন, ‘নাহিদা রুনাইসহ পিকে হালদারের অন্য বান্ধবীদের বিষয়েও তদন্ত চলমান রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের প্রমাণ মিলেছে। নাহিদা রুনাইয়ের ব্যাংক হিসাবে ৭০ কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনও শনাক্ত হয়েছে।’
এছাড়া পিকে হালদার বিষয়ক যে ৫২টি মামলা রয়েছে, সেগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে বলেও জানান দুদকের এই উপপরিচালক।
সূত্র বলছে, ২০১২ সালে নাহিদা রুনাই অফিস এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগদান করেন পিকে হালদারের প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ফিন্যান্স লিমিটেডে। সেই থেকেই রুনাইয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা। প্রতিষ্ঠানটির এমডি পিকে হালদারের বান্ধবী হওয়ার সুযোগে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন নাহিদা রুনাই। বিপরীতে পিকে হালদারও বান্ধবী রুনাইকে ব্যবহার করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের জন্য।
দুদক সূত্র জানায়, অফিস এক্সিকিউটিভ থেকে পিকে হালদারের কল্যাণে ক্ষমতাধর ‘বড় আপা’ বনে যান নাহিদা। রিলায়েন্স ফিন্যান্স থেকে নাহিদাকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে নিয়ে আসেন পিকে হালদার। দ্রুততম সময়ে চারটি পদোন্নতি দিয়ে তাকে ভাইস প্রেসিডেন্টও করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পিকে হালদার তার ঘনিষ্ঠ দুই বান্ধবী নাহিদা রুনাই ও অবন্তিকা বড়ালকে নিয়ে ২০-২৫ বার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। দুজনের মধ্যে কে পিকে হালদারের সঙ্গে বেশি সময় কাটাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতাও চলতো।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘নাহিদা রুনাই আনান কেমিক্যাল লিমিটেড নামে একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র তৈরি করে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড থেকে ৭০ কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন।’
মামলার নথি বলছে, পিকে হালদারের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তার ৬২ জন সহযোগীর খোঁজ পায় দুদক। সহযোগীদের মধ্যে দুই বান্ধবী নাহিদা রুনাই ও অবন্তিকা বড়াল অন্যতম। কেবলমাত্র আনন্দ বিনোদন দিয়েই দুই বান্ধবী শত কোটি টাকার মালিক।
পিকে হালদারকে শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ করে রাখতেন অবন্তিকা ও রুনাই। পিকে হালদারকে নিজের কবজায় রাখতে দুই বান্ধবীর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনার বিবরণও পাওয়া গেছে আদালতে দেওয়া পিকে হালদারের সহযোগী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীর জবানবন্দিতে।
শুধু অর্থ বিত্ত আর বৈভবের টানে দুই বান্ধবী পিকে হালদারকে একান্তে কাছে টেনে রাখতেন বলে স্বীকার করে দুদক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে উজ্জ্বল কুমার নন্দি বলেছেন, ‘পিকে হালদারের প্রতিষ্ঠানগুলোতে রুনাইকে বড় আপা এবং অবন্তিকাকে ছোট আপা বলে সম্বোধন করা হতো। রুনাই চালাতেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং আর অবন্তিকা চালাতেন পিপলস লিজিং।’
দুর্নীতি ফাঁস হলে ২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে দেশ থেকে পালিয়ে যান পিকে হালদার। অপরদিকে পিকে হালদার ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ৫২টি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে একটি মামলার বিচারকাজ চলছে। বাকিগুলো তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পিকে হালদারের সহযোগী শঙ্খ বেপারী, রাশেদুল হক, অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ছাড়া পিকে হালদারের এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে পালানোর পর ২০২২ সালের ১৪ মে পিকে হালদারকে গ্রেপ্তার করে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। তিনি ভারতের কারাগারে রয়েছেন।
Leave a Reply