৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । সন্ধ্যা ৭:৩৫ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা আর ভিসির স্বেচ্ছাচারিতায় দেশের অন্যতম স্বনামধন্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তার গৌরব হারাতে বসেছে। নিয়মনীতির বালাই না করে একের পর এক অনিয়মে জর্জরিত দেশের এ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি। ব্যাপক অনিয়ম,অতিরিক্ত নিম্মমানের শিক্ষক নিয়োগ,অবকাঠামোগ স্থবিরতায় গৌরব হারাতে বসেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড.দিদারুল আলমের সরাসরি প্রত্যক্ষ যোগসাজসে নানা অনিয়মনে ডুবতে বসেছে স্বনামধন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সরকারী মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের ধাক্কা। দুনর্ীতি-অপচয়ে নেই তদারকি
অতিমারী এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মন্দা মোকাবিলায় সরকারী এবং ইউজিসির কৃচ্ছতা সাধনের কঠোর নির্দেশনাকে ধোরাই কেয়ার করছেন ভিসি। ইউজিসিথর কঠোর নির্দেশনা উপেক্ষা করে সম্প্রতি ভিসি ড. দিদারুল আলম শিক্ষক সমিতির কথিত একাংশের সদস্যদের পরিবারসহ কক্রবাজারের বিলাসবহুল আনন্দ ভ্রমনের জন্য কয়েক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেন। যা ইউজিসির নির্দেশনার সরাসরি বরখেলাপ। ভিসি কতর্ৃক সরকারী নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখানোর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে এবং ইউজিসিতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃস্টি হয়েছে।
ৃ
প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগ প্রক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অস্থায়ী পদে কর্মরত প্রভাষকগণকে স্থায়ী করার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা হলেও প্রায় প্রতিটি বিভাগেই শিক্ষা ছুটির বিপরীতে অননুমোদিত পদে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। ২০২১ সালের মে মাসে শিক্ষা মন্ত্রনালয় এক প্রতিবেদনে নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধি ‘স্ট্যান্ডার্ডথ নয় বলে উল্লেখ করে পরবর্তী সকল নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসি কর্তৃক প্রণীত নিয়ম যথাযথভাবে অনুসরণ করে শিক্ষক নিয়োগের নির্দেশনা প্রদান করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও মানহীন নিয়োগবিধি অনুসরণ করে সম্প্রতি অননুমোদিত অতিরিক্ত বায়ান্ন জন শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনভাতা খাতে কেবলমাত্র ইউজিসি কর্তৃক অনুমোদিত জনবলের বরাদ্দ থাকায় অননুমোদিতে পদের শিক্ষকদেরবেতন প্রদান নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। অতিরিক্ত শিক্ষকগণের বেতনের ব্যাপারে হিসাব পরিচালক ও কোষাধ্যক্ষের লিখিত পর্যেবক্ষণ সত্ত্বেও উপাচার্য স্থায়ী শিক্ষকগণের বেতন বরাদ্দ হতে বেআইনিভাবে অনুনমোদিত পদের শিক্ষকদের বেতন প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন; এর ফলে বাজেট ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে সামনের মাসগুলোতে স্থায়ী ও অস্থায়ীসহ সকলেরই বেতন বন্ধ হওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। যেসব বিভাগে ইতোমধ্যে পর্যাপ্ত শিক্ষক আছেন, সেখানে নিজেদের খেয়ালখুশি পছন্দমতো অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে- যেমন: ফার্মেসি, মাইক্রোবায়োলজি,ফিশারিজ)। অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, আইন, বায়োকেমিস্ট্রি, প্রাণিবিদ্যা ইত্যাদির মতো অনেক বিভাগে শিক্ষকের মারাত্মক ঘাটতি সত্বেও সেখানে বিজ্ঞাপিত পদের সমসংখ্যক বা কম শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগের এই বিতর্কিত প্রক্রিয়া শেষ করেই নতুন করে অতিরিক্ত কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হর্য়েছে। কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে উপাচার্যের ব্যাকি ব্যাক্তিগত ড্রাইভারকে দায়িত্ব
থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে; এক্ষেত্রে উপাচার্য দায় এড়ানোর জন্য উক্ত ড্রাইভারকে রেজিস্ট্রার দপ্তরের ড্রাইভার বলে উল্লেখ করছেন।
শিক্ষার মানে চরম অবনতি
সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল বিভাগের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। ক্লাসরুমের তীব্র সংকটের কারণে পর্যাপ্ত সংখ্যক ক্লাস না নিয়েই কোর্স অসম্পূর্ণ রেখে শিক্ষকরা পরীক্ষা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্যবহারিক কোর্সসমূহ নামকা ওয়াস্তে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ক্লাসরুম সংকটসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার জন্য দায়িত্বশীল শিক্ষকগণ উপাচার্যেক একাডেমিক কাউন্সিল মিটিং আহ্বানের অনুরোধ জানালেও জবাবদিহির ভয়ে উপাচার্য গত ৬ মাসে কোন মিটিং করেননি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়নকার্যে চরম স্থবিরতা
বর্তমান উপাচার্য ২০১৯ সালের মে মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। প্রায় তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে চরম স্থবিরতা বিরাজ করছে। পূর্বতন ভিসির আমলে শুরু করা কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ করা ব্যতীত বর্তমান উপাচার্য নতুন কোন প্রকল্প শুরু করতে সমর্থ হননি। বর্তমান প্রশাসনের অদক্ষতার কারণে চলমান একাডেমিক বিল্ডিং-৩ এর প্রকল্প শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাতিল ঘোষণা করা হয়।
বাড়ি ভাড়া নিয়েঅনিয়ম
উপাচার্যের নিয়োগপত্রের শর্তানুসারে উপাচার্যেক তার জন্য নির্ধারিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলোতে বসবাস করতে হবে যা উনার প্রাপ্ত বাড়ীভাড়ার সাথে সমন্বয় হয়। কিন্তু বর্তমান উপাচার্য বাংলোতে অবস্থান না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে ভিআইপি রুম ব্যবহার করেন। অবৈধভাবে গৃহীত বাড়ি ভাড়া ফেরত প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও উপাচার্য বর্তমান অর্থবছরে তার বেতন বিবরণীতে কোন বাড়ী ভাড়াই প্রদর্শন করেন না যা অন্য গোপন কোন একাউন্টে জমা রাখার অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান উপাচার্য খুবই অনিয়মিত অফিস করেন; যা তার বেতন বিবরণীর ‘গেস্ট হাউজেরথ ভাড়া পর্যেবক্ষণ করলেই প্রমাণত হয়: চলতি বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসে উনি মাত্র ১১ দিন অফিস করেন। এছাড়া বিগত ডিসেম্বর মাসে ৯ দিন, নভেম্বর মাসে ১২ দিন, আগস্ট হতে অক্টোবর এ তিন মাসে ৪৪ দিন, জুলাই মাসে মাত্র ২১ দিন অফিস করেছেন। এমনকি ঈদুল ফিতরের বন্ধের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস প্রদানের জন্যও উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ে না আসায় এ সংক্রান্ত ফাইলটি ঢাকায় নিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে আনা হয়।
রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য নিয়োগে স্বেচ্ছাচারিতা
রিজেন্ট বোর্ডে শিক্ষক প্রতিনিধি মনোনয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও উপাচার্যের অনুগত শিক্ষক গ্রুপের সদস্য ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়। আইন মোতাবেক একাডেমিক কাউন্সিলে নির্বাচনের মাধ্যমে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য নিয়োগের বিধান থাকলেও উপাচার্য তা অমান্য করেন। অধিকন্তু একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক লিখিত আপত্তি জানালেও উপাচার্য তা আমলে নেননি।
উচ্চ আদালতের আদেশ অবজ্ঞা
বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. সুবোধ কুমার সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অমান্য করে চেয়ারম্যান পদ হতে গত ১লা নভেম্বর ২০২১ তারিখে অপসারণ করা হয় এবং একজন সহকারী অধ্যাপককে উক্ত পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। ড. সরকার এ নিয়োগের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করলে হাইকোর্ট ও পরবর্তীতে চেম্বার জজ বেঞ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ অবৈধ ঘোষনা করে এবং ড. সরকারকে চেয়ারম্যান পদের ১লা নভেম্বর হতে পুনর্বহাল করার আদেশ প্রদান করেন। আদালতের আদেশ ও ড. সরকারের বারংবার আবেদন সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১লা নভেম্বর হতে পুনর্বহালের কোন চিঠি প্রদান করেনি। অন্যদিকে, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে নিজের পছন্দ মতো ডিন নিয়োগের লক্ষ্যে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সময়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ডিন ড. মাহবুবুর রহমানকে বেআইনিভাবে জেষ্ঠ্যতা প্রদান করা হয়। সরকারী পদোন্নতি নীতিমালা অনুসারে পূর্ববর্তী পদের জেষ্ঠ্যতা বজায় রাখার নির্দেশনা রয়েছে। অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে রিট করলে আদালত রুল নিশি জারি করে। এভাবে ভিসির একের পর এক অনিয়ম অব্যবস্থাপনায় পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হয়ে ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে পৌছেছে।
Leave a Reply