২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ । বিকাল ৩:১৫ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
স্টাফ রিপোর্টার॥
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ১১ তলা ভবন নির্মাণে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতির নয় ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। নির্মাণকাজে নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহার ও নকশাবহির্ভূত কাজ করতে গিয়ে নানা জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। কালক্ষেপণের কারণে দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়েও তিন বছরের কাজ ৯ বছরে শেষ করা যায়নি। সর্বশেষ বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে কিনা, তাও অনিশ্চিত।
অভিযোগ উঠেছে, ভবনটি নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতার পেছনে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দায়ী। প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে অর্থ লোপাটের উদ্দেশ্যেই ধীরগতিতে নির্মাণকাজ চালানো হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান ও ভবন নির্মাণের কোরীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্টদের দিকেই অভিযোগের তীর।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর নিজামুল হকও (সদ্য বিদায়ী) ভবন নির্মাণ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রকল্প পরিচালককে প্রত্যাহার করে নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নৌ খাতের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার স্বার্থে ২০১৪ সালে গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) নামে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় নৌপরিবহন অধিদপ্তরকে। প্রকল্পের মোট ৩৮২ কোটি টাকার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণ সহায়তা ৭০ শতাংশ ও বাকি ৩০ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিলের। তিন বছরমেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ সময় ছিল ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। পরে দুই দফায় প্রকল্পটির কাজের পরিধি বাড়িয়ে এর নামকরণ হয় এস্টাবলিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)। একই সঙ্গে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৭৭৯ কোটি টাকা এবং বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০২৪ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত করা হয়।
উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন অবকাঠামো স্থাপনের পাশাপাশি ইজিআইএমএনএস প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হচ্ছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জন্য ১১ তলা ভবন। অন্যান্য স্থাপনার মতোই এই ভবনটির নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। পরে সময় বাড়িয়ে করা হয় ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় পুরো প্রকল্পের পাশাপাশি ভবনটি নির্মাণেরও সময়সীমা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় ১১ তলা ভবনটির নিচতলা থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা, যা দক্ষিণ কোরিয়া সরকার দেশটির এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে দেবে। পরে আরও তিনতলা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়ে নবম থেকে ১১ তলা পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। এই অর্থ দেওয়া হচ্ছে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। এ প্রকল্পের মূল ঠিকাদার কোরীয় কোম্পানি এলজি সামিহ। কোম্পানি এ কাজে বাগদাদ কনস্ট্রাকশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সহঠিকাদার নিয়োগ করেছে। তারাই ভবন নির্মাণসহ সাজানোর কাজ করছে।
সম্প্রতি ভবনটিতে গিয়ে জানা গেছে, নিচতলায় ফায়ার ফিটিংসের যে কাজ করা হয়েছে, তাতে নানা অসংগতি রয়েছে। এমনকি ভবনের নকশা অনুমোদনের সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের যে ছাড়পত্র জমা দেওয়া হয়েছে, সেটিও জাল। গত ৭ মে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়, এই ভবনের অনুকূলে কোনো ছাড়পত্রই প্রদান করেননি তাঁরা।
ভবনটির বেজমেন্টে পাওয়ার সাব-স্টেশন ও জেনারেটর হাউস পাশাপাশি স্থাপন করে ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই ঝুঁকি এড়াতে অতিরিক্ত প্রায় ৬ লাখ টাকা ব্যয় করে স্থাপনা দুটিকে আলাদা করতে হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন তলা ছিদ্র করে সিঁড়ির সামনে ফায়ার ফাইটিং কেস বসানো হয়েছে। এটিও যে কোনো সময় ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
ভবনের দ্বিতীয় তলার সিলিংয়ে কিছু এয়ার কন্ডিশনের তার এলোমেলো পড়ে আছে। এ পর্যন্ত একটিও এসি লাগানো হয়নি। মহাপরিচালকের কক্ষ ছাড়াও তৃতীয় তলার সব জায়গায় নিম্নমানের সামগ্রী লাগানো হয়েছে। তৃতীয় তলায় কোনো এসি লাগানো হয়নি, লাইটও নেই। অথচ এই ফ্লোরের জন্য ৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা খরচের কথা বলা হচ্ছে। সাততলা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন তলায় অধিকাংশ দরজা নিম্নমানের প্লাস্টিকের তৈরি। অথচ দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী কাঠের দরজা লাগানোর কথা। এ ছাড়া কয়েকটি তলায় মেঝেতে টাইলস বসানো হয়নি। ওয়াশরুমে স্থাপন করা বেসিন, কমোড ও অন্যান্য ফিটিংসও নিম্নমানের। বৈদ্যুতিক তারও মানসম্মত নয় বলে জানান নির্মাণসংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে কমডোর মোহাম্মদ নিজামুল হক সম্প্রতি বলেন, তাঁকে না জানিয়ে এবং কোনো ধরনের অনুমোদন না নিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে ১১ তলা ভবন নির্মাণসহ পুরো প্রকল্পের কাজ চলছে। এ জন্য প্রকল্প পরিচালক দেলোয়ার রহমান ও কোরীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘এলজি আল সামিহ’ দায়ী।এরাই নয় ছয় করেছে সকল কাজে, সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্পের কাজে ভাটা পড়েছে। তাঁর দাবি, মহাপরিচালক হিসেবে তাঁর যোগদানের আগে প্রকল্পের কাজ মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রকল্পের কাজ প্রায় ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন– এ প্রশ্নের জবাবে কমডোর নিজামুল হক বলেন, ‘প্রকল্পের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় নজরে আসার পর ব্যবস্থা নিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি। কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও বলেছি। প্রকল্প পরিচালককে প্রত্যাহার করে নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের জন্য চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছি।’
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তাঁর দপ্তর থেকে বলা হয়, ‘প্রকল্প পরিচালক অসুস্থ থাকায় তাঁর পক্ষে বক্তব্য দেওয়া সম্ভব নয়।’ পরে উপপ্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ফরহাদ জলিল বিপ্লব প্রকল্প পরিচালকের পক্ষ থেকে দাবি করেন, ১১ তলা ভবন নির্মাণে কোনো অনিয়ম হয়নি। দরপত্রের শর্ত এবং এ-সংক্রান্ত সরকারি বিধিবিধান মেনেই সবকিছু করা হচ্ছে।
আরো আসছেপ্রকল্প পরিচালক আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের মহা র্দূনীতির বিবরণ আর তা দেখতে চোখ রাখুন দৈনিক সবুজ বাংলাদেশ এর পাতায়।
Leave a Reply