১১ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । বিকাল ৫:১১ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
রায়হান হোসাইন, চট্টগ্রামঃ-
আসামির স্ত্রীকে হেনস্তা করার ঘটনার সংবাদ প্রকাশ করায় একুশে পত্রিকাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানা থেকে প্রত্যাহার হওয়া এসআই মাহবুব মোরশেদ।
বুধবার (২০ এপ্রিল) শুক্রবার একুশে পত্রিকায় ফোন করে এসআই মাহবুব মোরশেদ বলেন, ‘আপনারা তো আমার বিরুদ্ধে লিখেছেন। এখন তো তদন্তে আমার বিরুদ্ধে কোন কিছু প্রমাণ হয়নি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। এখন এই নিউজ করেন।’
তখন একুশে পত্রিকার পক্ষ থেকে এসআই মাহবুবকে বলা হয়, ‘আপনি যে নির্দোষ সেই তদন্ত প্রতিবেদনটি পাঠান। আমরা বার্তা বিভাগে পাঠিয়ে দেব। তারা নিউজ করে দেবে।’
পরে দেখা গেল, সীতাকুণ্ড সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিমের তৈরি করা সেই তদন্ত প্রতিবেদনে আসামির স্ত্রীকে লাথি দেওয়া, হেনস্থা করার প্রমাণ পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসআই মাহবুবের চাওয়া অনুযায়ী বৃহস্পতিবার নিউজটা করতে গিয়ে তদন্তে যা উঠে এসেছে তাই তুলে ধরা পড়লোপ্রতারক হয়। সঙ্গতকারণে নিউজটার শিরোনাম হয় ‘সীতাকুণ্ডে এসআইয়ের বিরুদ্ধে আসামীর স্ত্রীকে হেনস্তার সত্যতা মিলেছে’
এই নিউজ প্রকাশের পর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন এসআই মাহবুব। একুশে পত্রিকার ফেসবুক পেইজে দেওয়া নাম্বারে আজ শুক্রবার দুপুরে ফোন করে এসআই মাহবুব মোরশেদ দাবি করেন, ‘এক লাখ টাকার বিনিময়ে একুশে পত্রিকা এই নিউজ করেছে।’
তখন একুশে পত্রিকার পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের রিপোর্টার এই নিউজ করার জন্য টাকা নিয়েছেন, সেই প্রমাণ দিন। প্রমাণ ছাড়া এত বড় অপবাদ দেওয়া হলে আমরা মেনে নেব না, আইনগত ব্যবস্থা নেব।’
এরপর এসআই মাহবুব উচ্চবাচ্য করতে শুরু করেন; বলেন, ‘বেশি বাড়াবাড়ি করতেছেন, আমি মামলা করবো। আদালতে দেখা হবে। আমার কাছে রেকর্ড আছে।’
রেকর্ড থাকলে দিতে বললে তার সদুত্তর না দিয়ে এসআই মাহবুব বলেন, ‘আমি উপরে যাব, দেখে নেব।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সীতাকুণ্ড সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এসআই মাহবুব যদি কোনও হুমকি দিয়ে থাকে, এ বিষয়ে পুলিশ সুপার মহোদয় বরাবর আপনারা অভিযোগ করতে পারেন। অথবা সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ করতে পারেন। এরপর নিশ্চয়ই তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার কারণেই এসআই মাহবুবকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার ব্যাপারে আর কিছু বলার আগ্রহ নেই আমার।’
এর আগে গত ১৭ এপ্রিল সীতাকুণ্ড থানায় কর্মরত এসআই মাহবুব মোরশেদের বিরুদ্ধে লাথি মেরে আঘাত, অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ, অপমান, দরজা ভেঙে ঘরের ভেতরে প্রবেশ, মূল্যবান কাগজপত্র, ১ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা, ৮ আনা স্বর্ণ ও ২ টি স্মার্টফোন লুটের অভিযোগ তুলে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন খালেদা আক্তার নামে এক নারী। ওই নারীর স্বামী নুরুল আলম ইরান একটি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি।
অভিযোগে খালেদা আক্তার উল্লেখ করেন, গত ১৬ এপ্রিল শনিবার দুপুরে সঙ্গীয় ফোর্স ও একজন সোর্স নিয়ে সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ভাটেরখীলস্থ নুর আহম্মদের নতুন বাড়িতে তার স্বামীভাই ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি মো. নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করতে যান এসআই মাহবুব মেরশেদ। কিন্তু তার স্বামীকে না পেয়ে এসআই মাহবুব মোরশেদ খালেদাকে তাদের প্রতিবেশীর সাথে চলা জমি সংক্রান্ত মামলার জামিন আছে কি না জানতে চান।
খালেদা আক্তার আদালত থেকে জামিনে আছেন জানালে এসআই মাহবুব মোরশেদ তাকে জামিনের কপি দিতে বলেন। এসময় খালেদা আক্তার জামিনের কপি তার দেবরের কাছে আছে এবং তিনি আসলে দেখাবেন বলে জানালে এসআই মাহবুব মোরশেদ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে এসআই মাহবুব মোরশেদ খালেদাকে তার ঘরের আলমারির চাবি দিতে চাপ প্রয়োগ করেন। এসময় খালেদা আক্তার চাবি দিতে অস্বীকৃতি জানালে এসআই মাহবুব মোরশেদ তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন এবং ২ বার তাকে লাথি দেন। পরে ভয়ে ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে আলমারির চাবি দিয়ে দিলে মাহবুব মোরশেদ আলমারি খুলে নগদ ১ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা, আট আনা স্বর্ণ, ২টি স্মার্টফোন ও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র লুট করে নিয়ে যায়।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, নগদ ১ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা তাদের গরু বিক্রি টাকা যা বসতঘরে গচ্ছিত ছিল। তার ছেলে রিফত হোসেন জনি (১৭) এসআই মাহবুব মোরশেদ ও সোর্স নুরুজ্জামানকে বাধা দিলে তারা তাকেও মারধর করেন এবং মাথায় বন্দুক তাক করে পরিবারের সবাইকে প্রাণনাশের হুমকি দেয় এবং ব্যাংকের, জন্মনিবন্ধনসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র লুট করে নিয়ে যায়। অভিযোগে ৩ জন পুরুষ ও ৪ নারীসহ মোট ৭ জনকে স্বাক্ষী করেন খালেদা আক্তার।
গত ১৭ এপ্রিল পুলিশ সুপার বরাবর অভিযোগ দেয়ার পরই অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। একইসাথে ওইদিন রাতেই এসআই মাহবুব মোরশেদকে সীতাকুণ্ড থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়।
অভিযোগের তদন্ত করে ১৮ এপ্রিল পুলিশ সুপারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল করিম। পুলিশের সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসআই মাহবুব মোরশেদ আসামি নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করেন। পরে তাকে আধা কিলোমিটার ধাওয়া করে ধরতে ব্যর্থ হলে দরজা খুলতে দেরি হওয়ার বিষয় নিয়ে তার স্ত্রী খালেদা আক্তারের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। এসময় খালেদা আক্তারকে লাথি মারেন এসআই মাহবুব মোরশেদ এবং তার ও তার ছেলের সাথে অশোভন আচরণ করেন।
শুধু তাই নয়, ছেলের মাথায় বন্দুক তাক করে প্রাণনাশের হুমকি ও ভয় দেখিয়ে আলামরি থেকে কাগজপত্র লুট করেন এসআই মাহবুব মোরশেদ। এসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের অভিযোগের উপযুক্ত ও নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং খালেদা আক্তার দুটি গরু বিক্রি করে পুনরায় দুটি গরু ক্রয় করেন বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অভিযানে এসআই মাহবুব মোরশেদের সঙ্গীয় অফিসার এএসআই হাবিবুর রহমান সম্পর্কে বাদী ও বাদীর মানিত স্বাক্ষীদের বক্তব্য পর্যালোচনায় বিরূপ কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
উক্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, পুলিশ বাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত অফিসার হয়েও কর্তব্য-কর্মে স্বেচ্ছাচারিতা, অসদাচরণ ও শৃঙ্খলা পরিপন্থী পরিলক্ষিত হয়, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রতিবেদনে অভিযুক্ত এসআই মাহবুব মোরশেদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
Leave a Reply