২৬শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ । রাত ১:৫৪ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
আরবী গাস্সুন শব্দের অর্থ মানে প্রতারণা করা বা ধোঁকা দেয়া। ইসলামে ধোঁকা দেয়া বা প্রতারণা করা নিষিদ্ধ। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) বাজারে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তিনি খাদ্যের ভেতর হাত প্রবেশ করে দেখলেন ভেতরের খাদ্যগুলো ভিজা বা নিম্নমান। এ অবস্থা দেখে রাসুল (সা.) বললেন, হে খাবারের মালিক এটা কী? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! এতে বৃষ্টি পড়েছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি সেটাকে খাবারের উপরে রাখলে না কেন : যাতে লোকেরা দেখতে পেত? “যে ধোকা দেয় সে আমার উম্মত নয়।” (মুসলিম : ১০২, কিতাবুল ঈমান, বাবু কাউলিন নবী (সা.) মান গাসসানা ফা লাইসা মিন্না)
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ধোঁকা বা প্রতারণার ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক। বিভিন্নভাবে মানুষ ধোঁকা বা প্রতারণার শিকার হয়। মানুষের আচার-আচরণ, লেনদেন, আদান-প্রদান, কথা-বার্তা, কাজে-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে মানুষ প্রতারিত হয়। যারা ধোঁকা ও প্রতারণা করে তাদেরকে ধোঁকাবাজ বা প্রতারক বলা হয়। ইসলামে ধোঁকা ও প্রতারণা করা নিষিদ্ধ। বর্তমানে ধোঁকা ও প্রতারণা মহামারীর মতো অত্যন্ত ব্যাপকতা লাভ করেছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রতারণা অনেকটা গা সহায় হয়ে পড়েছে অথবা বলা যেতে পারে এই মহা অন্যায়ের কাছে আমরা আত্মসমর্পন করেছি অথবা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, প্রতারণা ও ধোঁকার সামনে আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। ফলে এটিকে কেউ এখন অপরাধ মনে করে না। একটি নিছক সাধারণ বিষয় হিসাবে সমাজে প্রচলিত হয়ে পড়েছে। কারণ শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ইসলামের নামদারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং অনৈসলামী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান দু’জনের বিবেকই মরে গেছে। খাদ্যে ভেজাল ও বিষাক্ত ফরমালিন মেশানো, ওজনে কম দেয়া, বিভিন্ন পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দ্বারা ন্যায় বিচারকে প্রভাবিত করা এবং আদালতের রায় নিজের পক্ষে নিয়ে নেয়া, সরকারী ডাক্তারদের কর্তব্যে অবহেলা করে নিজের প্রইেভেট ক্লিনিকে রোগীকে নিয়ে যাওয়া, স্কুল শিক্ষক ক্লাশের পড়ার বদলে নিজের কোচিং বাণিজ্য করা, মিথ্যা শপথের মাধ্যমে নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পালন না করা ইত্যাদি বিষয়গুলো সমাজে সাধারণ বিষয় হিসাবে পরিগণিত হয়ে পড়েছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এগুলোকে এখন আর কেউ অপরাধ মনে করে না।
আপনার বিবেক যদি সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে আপনি কাউকে ধোঁকা দিতে পারেন না বা কারো সাথে প্রতারণা করতে পারবেন না। আপনি নিজেও কারো দ্বারা প্রতারিত হবেন না। যেকোন মানুষকে প্রতারিত করা এমন কি কোন অবুঝ প্রাণীকেও প্রতারিত করা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। ধোঁকা-প্রতারণা করা একটি ঘৃণিত ব্যাধি। ইবনে উমার (রা.) হতে বর্ণিত। এক লোক নবী (সা.)-এর কাছে উল্লেখ করল যে, সে কেনা-বেচার সময় প্রতারিত হয়ে যায়। তিনি বললেন, যখন তুমি কেনা-বেচা করবে তখন বলবে (কোন) ধোঁকাবাজি নেই।(বুখারী:৬৯৬৪, ২১১৭, কিতাবুল হাইল, বাবু মা উনহা মিনাল খিদায়ে ফিল বুয়ু, (আ.) প্র:৬৪৮০, ইফা : ৬৪৯৩)
ধোঁকা-প্রতারণা নীতি বিবর্জিত হারাম কাজ। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দেয় বা প্রতারণা করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” (মুসলিম : ১০২) তাই ধোঁকা-প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ হারাম। এ ধরনের সম্পদ দিয়ে উদর পূর্তি করার কারণে তার শরীর হারামে পরিপূষ্ট হয়। এ ধরনের অর্জিত সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় দান-সাদকা করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। আমাদের সামাজিক জীবনে এমন অনেক ধোঁকাবাজ-প্রতারককে দেখা যায়, যারা দান-সদকার ব্যাপারে উদার হস্ত। মসজিদ-মাদরাসার কমিটিতে তিনি সভাপতি ও সম্পাদক পদে নিয়োজিত। মসজিদ-মাদরাসার নির্মাণ কাজে তার দানের অংশ সবচেয়ে বেশি। এ ধরনের ব্যক্তিদের দান-সদকা আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না।
ধোঁকা-প্রতারণার শাস্তি অত্যন্ত মারাত্মক। কিয়ামতের দিনে সে নিঃস্ব হত দরিদ্র ও দেউলিয়া হয়ে পড়বে। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: তোমরা কি বলতে পারো, দরিদ্র কে? তারা বললেন, আমাদের মধ্যে যার দিরহাম (টাকা-কড়ি) ও আসাবাপত্র (ধন-সম্পদ) নেই সেই তো দরিদ্র। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই প্রকৃত অভাবগ্রস্ত, যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে : অথচ সে এই আসবে যে, সে গালি দিয়েছে, একে অপবাদ দিয়েছে, এর সম্পদ ভোগ করেছে, একে হত্যা করেছে ও একে মেরেছে। এরপর তার কাছে (পাওনাদারের) প্রাপ্য তার নেক আমল থেকে পূরণ করা গেলে ঋণের বিনিময়ে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম : ৬৩৪৩, কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাহ ওয়াল আদাব, বাবু তাহরিমিজ জুলুম)
অন্যায়ভাবে কারো ক্ষতি করা হলে কিংবা প্রতারণার মাধ্যমে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা হলে সেটি হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক অপহরণের অপরাধে অপরাধী হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত ভয়ানক বিষয়। এ ধরনের অপরাধের গোনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না। তবে সে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে ক্ষমা নিয়ে নেয়, হয়তো বা আল্লাহ মহান মাফ করতেও পারেন। হাশরের মাঠে কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করার আগেই আপনাকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে সমঝোতা করতে হবে। অন্যথায় উপরের হাদীসে দেখেছেন কিভাবে দেউলিয়া হতে হবে। ধোঁকাবাজ ও প্রতারক জাহান্নামের ইন্ধনে পরিণত হতে হবে।
ওজনে কম-বেশি করাও একটি মারত্মক ধোঁকাবাজি-প্রতারণা। যারা ওজনে কারচুপি করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। তাদের অবস্থা এই যে, তারা লোকেদের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণমাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় কিংবা ওজর করে দেয়, তখন কম করে দেয়। এরা কি চিন্তা করে না, একটি মহাদিবসে এদেরকে উঠিয়ে আনা হবে? যেদিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আলামীনের সামনে দাঁড়াবে।” (সুরা মুতাফফিফীন : ১-৬) ওজনে কম-বেশি করা এমন একটি গোনাহ যে, এই ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য মহান আল্লাহ একজন নবী প্রেরণ করেন। মনে রাখতে হবে, মহান আল্লাহ হাশরে দাঁড়িপাল্লা কায়েম করবেন। সেখানে প্রত্যেকের আমলনামা মাপা হবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি কিয়ামতের দিন যথাযথ ওজন করার দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করবো। ফলে কোনো ব্যক্তির প্রতি সামান্যতম জুলুম হবে না। যার তিল পরিমাণও কোন কর্ম থাকবে তাও আমি সামনে আনবো এবং হিসেব করার জন্য আমি যতেষ্ট।” (সুরা আম্বিয়া:৪৭) সুতরাং মেপে দেবার সময় কমবেশ করবেন না। সঠিকভাবে মেপে দিবেন। কারো সাথে প্রতারণা করবেন না। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“মেপে দেবার সময় পরিমাপ পাত্র ভরে দাও এবং ওজন করে দেবার সময় সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। এটিই ভালো পদ্ধতি এবং পরিণামের দিক দিয়েও এটিই উত্তম।”(সুরা বনি ইসরাইল:৩৫) অর্থাৎ সঠিক ওজনে মেপে দেয়া হলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই কল্যাণ রয়েছে। দুনিয়ায় এর ফলে পারস্পরিক আস্থা ও সৌহার্দ প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা দু’জন দুজনের ওপর ভরসা করে, এর ফলে ব্যবসায় উন্নতি আসে এবং ব্যাপক সমৃদ্ধি দেখা দেয়। অন্যদিকে আখেরাতে এর শুভ পরিণাম পুরোপুরি নির্ভর করে ঈমান ও আল্লাহ ভীতির ওপর।
আরো মনে রাখতে হবে, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা শয়তানের বৈশিষ্ট্য। সে-ই প্রথম হযরত আদম (আ:) এবং মা হাওয়ার (আ:) এর সাথে ধোঁকবাজি বা প্রতারণা করেছিল। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর সে কসম খেয়ে বললো, আমি তোমাদের যথার্থ কল্যাণকামী। এভাবে প্রতারণা করে সে তাদের দুজনকে ধীরে ধীরে নিজের পথে নিয়ে এলো।”(সুরা আরাফ:২১-২২) ধোঁকা যেহেতু একটি মিথ্যা। সেহেতু ধোঁকাবাজ বা প্রতারক একজন খাঁটি মিথ্যাবাদীও বটে। কারণ কাউকে ধোঁকা দিতে হলে অবশ্যই মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। উল্লেখ্য, মিথ্যাবাদী একজন খাঁটি মুনাফিক। কারণ মুনাফিকের চারটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হলো, যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে। (বুখারী:৩৪) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যার মধ্যে একটি গুণও পাওয়া যাবে সেও মুনাফিক। ধোঁকাবাজ শয়তানের প্ররাচনায় মানুষ ধোঁকায় নিপতিত হয়। এমনকি অনেকে এই জঘন্য কাজে স্বাদ খুঁজে পায়। অথচ রাসুল (সা.) এ ধরনের ব্যক্তিকে মুসলিম উম্মাহ থেকে বহিষ্কার করেছেন। শয়তানি এই বৈশিষ্ট্য থেকে বেরিয়ে আসুন। কখনো কাউকে কোনভাবেই প্রতারিত করবেন না। সঠিক ও সৎকর্মনীতির ওপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুন।
সবা:স:জু- ৬৮৩/২৫
Leave a Reply