৪ঠা অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । বিকাল ৪:৫৫ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
একজন মুক্তিযোদ্ধা আঃ রশিদ হাওলাদার, যিনি অত্যন্ত দুঃখের সাথে তার নিজ হাতে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখেছেন। হুবহু তা তুলে ধরা হলো।
দৃষ্টি দিবেন কি?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে.
আসসালামুআলাইকুম.
আমি মোঃ আব্দুর রশিদ হাওলাদার. পিতা মরহুম মোঃ আসমত আলী হাওলাদার, পশ্চিম সরসী, ডাকঘর চাটরা, উপজেলা বাকেরগঞ্জ জেলা বরিশাল। দুটি কন্যা সন্তানের অবহেলিত হতভাগ্য এক পিতা। ১৯৬৯ ইংরেজি সনে প্রথম সাক্ষাৎ মিলেছিল বাংলাদেশের একমাত্র নেতা জেল জুলুম সহ্যকারি তেজস্বী পুরুষ সিংহের মত গর্জন বাংলার বাঘ শের-ই-বাংলা ফজলুল হকের মত পাকিস্তান সরকারি মহলের আতঙ্ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ নং কবাই ইউনিয়নের পাকিস্তান বাজার যার বর্তমান নাম শিয়ালঘুনী বাজার। আমি তখন নবম শ্রেণীর ছাত্র ১০ম শ্রেণীতে পদার্পণ করার পর আওয়ামী লীগের সংগঠনের জড়িত হইয়া জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম।
সংগঠনে যুক্ত হওয়ায় আমার প্রধান শিক্ষকের বকুনি এবং হুমকির মুখে পরতে হয়েছে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হায়েনা পশুদের এদেশীয় দোসর রাজাকার শান্তি বাহিনীর ভয়ে রাতের অন্ধকারে বাংলার মুক্তির জন্য বাবা-মা থেকে দূরে সরেছি বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানের রক্তগরম
ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ডাকে। Army person মরহুম এচহাক শরীফ, আলী আজীম মৃধা এদের নিকট থেকে গোপনে Training নিয়েছি। গ্রামে ২ মানুষের বাড়ি ঘুড়ে গ্রেনেট তৈরির জন্য নারিকেল পেরে দিয়েছিলাম সেদিন। গাড়ুড়িয়ার জাফর বাহিনীকে আশ্রয় দিয়েছিলাম আমার ঘরে। নাসির বাহিনী দুধল মডেল স্কুলে আগমন করলে আমার পাশাপাশি কুখ্যাত সাধারণ মানুষের আতংক আশ্রাব আলী শিকদারকে ধরে অস্রসহ ৩/৪ জনে ক্যাম্পে সোপর্দ করেছিলাম। দ্বিতীয়ত দত্তেরাবাদ নিবাসী বরিশাল শান্তি বাহিনীর অন্যতম সদস্য মরহুম আশ্রাব আলী আবাদীর বাড়ি অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর দলের সাথে আমি ছিলাম পথপ্রদর্শক। সেনের হাট এক অপারেশনে আমার শ্রদ্ধেয় শাহজাহান স্যার বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা রফিক ভাই, মুচুয়া কাদের ও আমি নৌকায় দাড় টেনে বহু কষ্ট করে বড় নদীতে (তেতুলীয়া) পরার পরে গানবোট সার্চলাইটের সামনে পরলে কোন রকম পালিয়ে আসি। এর পর আমার বিরুদ্ধে মরহুম মাওলানা আশ্রাব আলী আবাদী বরিশাল সেনাবাহিনীর দপ্তরে অভিযোগ দেয়ার পরে সেনাসদস্যরা রাঙামাটি নদী সংলগ্ন কবিরাজ হিন্দু এলাকা মুন্ডল বাড়ি ও সুর বাড়ি ঢোকার পূর্বে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে, পরে সূরবাড়ী অগ্নিসংযোগ চালায়। কবিরাজ থেকে চাটরা আসার পথে আমার পূর্বের (বছির হাওলাদার) বাড়ির সাঁকো (চার) পার হওয়ার জন্য সেনাসদস্য ও লালবাহিনী আমাদের এলাকায় ঢোকার মাধ্যম সাঁকোর মাঝের লাছনী বাশ এক ফুফার সহযোগীতায় ফালাইয়া দেওয়া হয়। এরপর ওরা প্রশ্ন করেছিলো “এধার হিন্দু হায়” এপাড় থেকে ফুফা বলেছিলেন “বহুদুর হায়”। ওরা চলে যায়। বিগত নয় মাস যুদ্ধ চলাকালীন আমার এলাকা চাটরায় হিন্দুবাড়ীর একটা গাছের পাতাও ক্ষতি করতে দেই নি।
আমার প্রধান শিক্ষক আমাকে খুব করে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বললে রাতের অন্ধকারে আমার সহপাঠী class friend (মরহুম) শাহজাহান ভাইকে নিয়ে চাটরা থেকে বরিশাল ১০/১১ মাইল পথ হেটে বরিশালের এপাড়ে এক বাড়িতে রাত্রি যাপন করি, পরে আবাদির বাহিনীর ভয়ে নাপ্তের হাট বরিশাল খেয়া পাড় হয়ে ১৩/১৪ মাইল পথ পায়ে হেটে বরিশাল থেকে ঝালকাঠি যাওয়ার পথে ২ জন রাজাকারের হাতে ধরা পড়ি কিছুক্ষণ পর তারা ছেড়ে দেয়। সন্ধ্যার পরে বরিশাল থেকে খুলনাগামী গাজী রকেট আসে এবং সাহস করে আমরা রকেটে উঠি। খুলনায় ভোরে পৌছে টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক এক বড়ভাই এলাকার আমাদের দেখে সেদিন আতকে উঠেছিলো। কারন ssc পরিক্ষার্থী সাইজে ছিলাম ছোট। ভারত যাওয়ার কথা ব্যক্ত করায় তিনি বলেছিলেন “দেশ স্বাধীন হবে তোমরা বাড়ি যাও” সময়টা ছিলো September এর শেষ দিকে। আরও বলেছিলেন peace committee এর certificate আছে কিনা। তখন খুলনা শহর খুবই গরম ছিলো। বাহিরে বের হলে গুলি করে। ২ দিন পালিয়ে থাকার পর খুলনা থেকে নতুন পথে এলোপাথারী পথ চলে আবার বাড়ি আসি। সে এক বীভৎস ইতিহাস। ভারতে যেতে পারি নাই। ৯ মাস বনে জংগলে কাদায় হাটলাম, মশার কামড় খাইলাম অথচ কিছু সংখ্যক মানুষ দেশের জন্য কিছুই করেনি সে এখন মুক্তিযোদ্ধা!
১৬ ই December দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের দিন ১৭ই ডিসেম্বর কালাম, নিমাই ও আমি ১০ মাইল পথ হেটে বরিশাল ৩০ গোডাউন চলে যাই। জিরাইনের সিরাজ বাহিনীর সাথে অস্র স্বস্রসহ ওই গোডাউন থেকে হেটে রহমতপুর ক্যাম্পে দেড় মাস থাকার পর অস্থায়ী সরকারের ঘোষণানুযায়ী চাকরীজীবি ছাত্র যাওয়ার নির্দেশ দেয়। আমি ছিলাম ssc পরিক্ষার্থী। বরিশাল সার্কিট হাউজ থেকে captain Omor এর Recommendation Card নিয়ে বাড়ি আসার পর ১৯৮৮ সনে কোন এক সময় আমার অনেকগুলো কাগজপত্র উইপোকায় নষ্ট করে ফেলে। এর পরে এক মুক্তিযোদ্ধা ভাই বলেছিলেন “২০ হাজার টাকা দিলে মুক্তিযোদ্ধা করে দেয়া যায়” আমি বলেছিলাম মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছি ঘুষ দেবোনা।
২০১৪ সনের April মাসে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী on line এ আবেদন করি। ২০১৭ সনের ২২ মে বাকেরগঞ্জ উপজেলায় বাছাই হয়। কাগজপত্রের উপরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ok শব্দ লিখলেও আমার কাগজ কি অবস্থায় কোথায় আছে জানিনা। অপরাধ টাকা দিতে পারিনি। যারা ৫০ হাজার বা এক লক্ষ টাকা দিয়েছে তারাই select হয়েছে। আমার বয়স ৬৬ বছর পাড় হয়েছে। টাকা ছাড়া রেশন কার্ড হয়না। বয়স্ক ভাতা হয়না। আমার এক শতাংশ চাষযোগ্য জমিও নাই। বড় মেয়েটা BA পাশ করেছে চাকুরী হয়না। ছোটটাও আগামী বছর BA পরিক্ষারথী। ছাত্র জীবনে গান গাইতাম ” মুজিব বাইয়া যাওরে, জনগনের নাও ওরে মুজিব বাইয়া যাওরে……
ছলেবলে ২৪ বছর রক্ত খাইছে চুষি জাতিরে বাচাইতে গিয়ে মুজিব হইলো দোষী
মুজিব বাইয়া যাওরে……। আমিকি নৌকার দ্বার ধরিনাই?
অনেক কষ্ট করেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলাম না। এমন মুক্তিযোদ্ধাও আছে কোন কর্মকান্ডে জড়িত ছিলোনা, অথচ সে মুক্তিযোদ্ধা। কার হাসি কে হাসে? কার বাড়ি কে থাকে? কার গাড়ি কে চালায়? স্বাধীনতার জন্য জীবন সংগ্রাম করলো কারা, আর স্বাধীনতার ফল ভোগ করলো কারা? বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার গ্রামের হতভাগ্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট কে দেখে? কি অপরাধ করেছিলাম?
Leave a Reply