৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । সকাল ১০:৫১ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
নিজস্ব প্রতিবেদক॥
দেশজুড়ে বহুল আলোচিত রাজধানীর গুলশানে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার (২২) মৃত্যুর ঘটনায় এবার ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। এতে ভিকটিমের প্রেমিক বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরকে প্রধান করে তার বাবা, মা ও তার স্ত্রীসহ আটজনকে আসামি করা হয়েছে। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ আদালতে মুনিয়ার বড় বোন নুসরাত জাহান তানিয়া বাদী হয়ে গতকাল সোমবার এই মামলা করেন। ওই আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ বেগম মাফরোজা পারভীন মামলাটি গ্রহণ করেন। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্ত করে আগামী ৬ অক্টোবরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন বিচারক। এদিন দুপুরে নুসরাতের জবানবন্দি রেকর্ড করেন আদালত। এতে সন্তুষ্ট হয়ে আদালত মামলাটি গ্রহণ করেন বলে জানিয়েছেন ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী মোখলেছুর রহমান।
কুমিল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত মো. সফিকুর রহমানের ছোট মেয়ে মুনিয়াকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণের পর হত্যার এই চাঞ্চল্যকর মামলায় প্রধান আসামি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর (৪২)। পাশাপাশি তার বাবা বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান (৭০), মা আফরোজা সোবহান (৬০), আনভীরের স্ত্রী সাবরিনা (৪০), হুইপপুত্র শারনের সাবেক স্ত্রী সাইফা রহমান মিম (৩৫), কথিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা (সম্প্রতি মাদকসহ গ্রেফতারের পর কারাবন্দি), পিয়াসার বান্ধবী ও ঘটনাস্থল গুলশানের ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রী শারমিন (৪০) ও তার স্বামী ইব্রাহিম আহমেদ রিপনকে (৪৭) এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। এর আগে গত ১৮ আগস্ট মুনিয়া আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলায় পুলিশের দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন আদালত। একই সঙ্গে আসামি আনভীরকে অব্যাহতি দিয়ে বাদীপক্ষের না-রাজি আবেদন খারিজ করে দেন ঢাকার মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী। মুনিয়ার বোন ও মামলার বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া জানান, এ মামলায় পুলিশের দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তিনি ১৭ আগস্ট না-রাজি আবেদন করেন। তখন মুখ্য আদালত হাকিমকে আবেদনটি গ্রহণ করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর জন্য আর্জি করেছিলেন। কিন্তু আদালত তার আবেদনে গুরুত্ব না দিয়ে পুলিশ প্রতিবেদন গ্রহণ করে আসামি আনভীরকে অব্যাহতি দেন। নুসরাত বলেন, তিনি গতকালও আদালতকে জানিয়েছেন, মুনিয়াকে হত্যার পর তিনি যে গুলশান থানায় অভিযোগ দিয়েছেন, এর কোনো জায়গায় আত্মহত্যার প্ররোচনার কথা উল্লেখ করেননি। মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পুলিশ ওই ধারায় মামলা নিয়েছে। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ মামলা হওয়ার কথা ছিল। গুলশান থানায় মামলা দায়েরের পর পুলিশ বলেছিল, ধর্ষণের বিষয়টি যোগ করে সেই ধারামতে আদালতে চার্জশিট দেবেন। কিন্তু পরবর্তীতে আসামিকে রক্ষা করতে সম্পূর্ণ উল্টো প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। মামলার বাদী আরো বলেন, ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ রিপোর্টে এসেছে, মুনিয়া দুই থেকে তিন সপ্তাহের গর্ভবতী ছিল ও তার শরীরে পুরুষের ডিএনএ মিলেছে। এরপরও তদন্ত কর্মকর্তা আসামির ডিএনএ ম্যাচিং পরীক্ষা করাননি। ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন মতে, মুনিয়াকে হত্যার আগেও ধর্ষণ করা হতে পারে। বিষয়গুলো গতকাল তিনি তার জবানবন্দিতে তুলে ধরেছেন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে বিচারক নতুন মামলা গ্রহণ করেছেন বলে জানান নুসরাত।
বাদীপক্ষে আইনজীবী হিসেবে ছিলেন অ্যাডভোকেট মাসুদ সালাহ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট শাহ মো. আবদুল কাইয়ুম, ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন, অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান ও অ্যাডভোকেট দুলালসহ আরো কয়েকজন আইনজীবী অংশ নেন। প্রধান আইনজীবী হিসেবে পরামর্শ দিয়েছেন প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। আইনজীবী মাসুদ সালাউদ্দিন বলেন, কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ এনে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীর, তার বাবা একই গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, আনভীরের মা আফরোজা সোবহান ও আনভীরের স্ত্রী সাবরিনাসহ আটজনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (২), দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় মামলা করা হয়েছে। আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর রেজাউল করিমও একই তথ্য জানান।
মামলায় অভিযোগ প্রসঙ্গে আইনজীবী সালাউদ্দিন বলেন, প্রধান আসামি সায়েম সোবহান আনভীর ফুসলিয়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মুনিয়ার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। দীর্ঘদিন স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করেও পরে তাকে বিয়ে না করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আর এতে তার পরিবারের সদস্যসহ অন্য আসামিরা সাহায্য করে। ঘটনার কিছুদিন আগে পিয়াসার মাধ্যমে মুনিয়াকে তুলে নিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আনভীরের মা ও স্ত্রী। তিনি আরো বলেন, মুনিয়ার মৃত্যুর অভিযোগটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) (২)/৩০ এবং দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারা মতে বিচার্য। সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ারভুক্ত। অথচ থানা পুলিশ ইচ্চাকৃতভাবে দুর্বল মামলা নিয়ে আসামিকে রক্ষা করতে চেয়েছেন।
মামলার বাদী নুসরাত দাবি করেন, তার ছোট বোন মুনিয়াকে প্রেমের জালে ফেলে কয়েক বছর ভোগ করেন আসামি আনভীর। পরবর্তীতে মুনিয়াকে দূরে ঠেলে দিতে আসামির পরিবার ষড়যন্ত্র করে। এরই ধারাবাহিকতায় ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়ে আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়। এতে আনভীরের আরেক প্রেমিকা সাইফা মিম, কথিত মডেল পিয়াসা, পিয়াসার বান্ধবী ও ফ্ল্যাট মালিকের স্ত্রী শারমিন ও তার স্বামী ইব্রাহিম ওরফে রিপনও জড়িত বলে তিনি মনে করেন। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তে এর সত্যতা বেরিয়ে আসবে বলে ভিকটিমের বোনের আশাবাদ।
প্রায় তিন মাস পর গত ১৯ জুলাই আলোচিত এ মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল হাসান। এর তিন দিন পর ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের তৎকালীন উপ-কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেছিলেন, মুনিয়ার আত্মহত্যা প্ররোচনা মামলায় বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তাই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর মুনিয়া ‘আত্মহত্যা’ মামলার মূল আসামিকে অব্যাহতি দেয়ায় পুলিশের সুপারিশের প্রতিবাদ ও পুনঃতদন্তের দাবি জানিয়ে পরবর্তীতে বিবৃতি দেন দেশের ৫১ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এতে আসামি আনভীরকে গ্রেফতার কিংবা জেরা না করায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।
গত ২৬ এপ্রিল রাতে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেই রাতেই বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন ওই তরুণীর বোন নুসরাত জাহান তানিয়া। সেখানে বলা হয়, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সায়েম সোবহান আনভীর দীর্ঘদিন শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন মুনিয়ার সঙ্গে। ওই বাসায় তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। কিন্তু বিয়ে না করে তিনি উল্টো মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন মুনিয়াকে। পরবর্তীতে নুসরাত দাবি করেন, তার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে আনভীর।
মুনিয়া ঢাকার মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মো. সফিকুর রহমান। তাদের বাড়ি কুমিল্লার উজির দীঘিরপাড়, পরিবার সেখানেই থাকেন। মৃত্যুর মাস দুয়েক আগে গত ১ মার্চ থেকে এক লাখ টাকায় ভাড়া নেয়া গুলশানের ওই ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন মুনিয়া। ওই বাসা ভাড়ার টাকা আনভীর দিতেন বলে পুলিশ ও স্বজনরা জানায়। গুলশানের বাসা থেকে মুনিয়ার মরদেহ উদ্ধারের পর সেখান থেকে তার মোবাইলসহ বিভিন্ন ধরনের আলামত উদ্ধার করে পুলিশ, যার মধ্যে ছয়টি ডায়েরিও ছিল। সিসিটিভির ভিডিও পরীক্ষা করে মুনিয়ার ফ্ল্যাটে আনভীরের যাতায়াতের প্রমাণ পাওয়ার কথা সেসময় পুলিশ জানিয়েছিল।
সূত্রঃ মানবকণ্ঠ
Leave a Reply