২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ । রাত ১:১৭ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
বিশেষ প্রতিনিধি
হঠাত করেই স্বর্ণ চোরাচালান, হীরা প্রতারণা, হুন্ডি বাণিজ্যসহ অজ্ঞাত সূত্রে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া দিলীপ কুমার আগারওয়ালকে ঘিরে বিতর্কের ঝড় শুরু হয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে সরকারের নানা পর্যায়েও সৃষ্টি হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতির। দুদক থেকে উচ্চ আদালত সর্বত্রই চলছে তোলপাড়। সুনির্দ্দিষ্ট তথ্য প্রমানভিত্তিক পাহাড়সম অভিযোগ থাকা সত্তেও বেজায় দাপটের চরম বেপরোয়া দিলীপ আগারওয়ালকে কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। এবার তার এমপি হওয়ার খায়েশ নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় খোদ ক্ষমতাসীন দলেই মারাত্মক বিভক্তির সূত্রপাত ঘটেছে।
সেখানকার সরকারদলীয় চার সংসদ সদস্যসহ ত্যাগী নেতা কর্মিদের বিরুদ্ধে দিলীপ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা নোংরা খেলায় মেতে উঠেছেন, শুরু করেছেন বিরোধ, বিভক্তির নানা তেলেসমাতি। বিভিন্ন দল, মতের দুই শতাধিক বহিরাগত লোককে লেলিয়ে নানা দুর্বৃত্তপনার মাধ্যমে মাফিয়া চক্রটি চুয়াডাঙ্গার আওয়ামীলীগকে আজ্ঞাবহ করার পাঁয়তারায় লিপ্ত হয়েছে। চলছে টাকার ছড়াছড়ি। আওয়ামীলীগের পরিবর্তে দিলীপ আগারওয়াল সেখানে নৌকা মঞ্চ বানিয়ে আগাম নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার সর্বত্রই দলীয় নেতা কর্মিদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।
দিলীপ আগারওয়ালের ইতিবৃত্ত
চুয়াডাঙ্গায় স্থানীয়ভাবে মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের সন্তান হিসেবেই পরিচিত দিলীপ কুমার আগরওয়ালা মাত্র দুই দশকেই আমূল বদলে নিয়েছেন নিজেকে। একদা জীবনযুদ্ধে নিজ বাড়িঘর ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে পাড়ি জমানো দলীপ কুমার ধূর্ততাসহ নানা কলা কৌশলকে পুঁজি করে সম্পদ প্রাচুর্যের পাহাড় জমিয়েছেন। তার পৈতৃক নিবাস চুয়াডাঙ্গায় সরেজমিন অনুসন্ধানকালেও নানা অবিশ্বাস্য কাহিনী বেরিয়ে এসেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারাও দিলীপ কুমার আগরওয়ালার রাতারাতি বিত্তশালী বনে যাওয়ার ঘটনাকে রীতিমত আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়া বলেই মনে করছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলায় দিলীপ কুমার আগরওয়াল এর পরিচিত মহলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্র জীবন শেষে বন্ধুদের সাথে যৌথ ঠিকাদারী ব্যবসা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। তার পিতার নাম অমিয় আগরওয়াল। বংশগত ভাবেই তার চাচার ছিল সিনেমা হলের (রূপছায়া বর্তমানে পান্না সিনেমা হল) ব্যবসা। তাতে আগরওয়াল পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা খুব একটা ছিল না। সিনেমা হলের ব্যবসায় ফুটফরমায়েশ পালনের পাশাপাশি হল সংলগ্ন জায়গা জমিতে দোকানঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েই চলতো সংসারের খরচ। একপর্যায়ে ছোটখাটো সাপ্লাইয়ের কাজকর্মেও যুক্ত হন দিলীপ আগারওয়াল। কিন্তু চুয়াডাঙ্গায় পার্টটাইম ঠিকাদারি আর সিনেমা হলের টুকটাক আয়ে পরিবারের দৈন্যতা কাটাতে ব্যর্থ হয়েই দিলীপ পাড়ি জমান ঢাকায়।
শুরুতে ঢাকার বিজয়নগরে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে নিজের অফিস করতেন এবং পাশের মহল্লায় দুই রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন তিনি। তবে ওই সময় ঢাকায় দিলীপ কুমার কিসের ব্যবসা করতেন তা তার ঘনিষ্ঠজনরাও কেউ কিছু বলতে পারেননি। কিন্তু দুই দশকের ব্যবধানে দিলীপ আগারওয়াল এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক, চুয়াডাঙ্গায় আসেন হেলিকপ্টারে চড়ে। আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন তিনি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজে প্রার্থী হবেন বলেও সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা দেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হবেন তিনি।
কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পোস্টার এবং বিগত নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের পোস্টারের সাথে নিজের ছবি ছেপে চুয়াডাঙ্গা জেলাজুড়ে প্রচারও করেন। এভাবে আওয়ামীলীগের নেতা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা এখনও অব্রাহত আছে। কিন্তু এতকিছুর পরও শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পাননি দিলীপ কুমার আগরওয়ালা।
চুয়াডাঙ্গার বড় বাজার এলাকার একজন প্রবীণ ব্যবসায়ী বলেন, ‘সিনেমা হলের ব্যবসার টাকাতেই যে দিলীপ কুমারদের জীবন জীবিকা নির্বাহ হতো- সেই দিলীপ কুমার ঢাকায় গিয়েই অফুরন্ত ধন সম্পদের মালিক হলেন কিভাবে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। চুয়াডাঙ্গা শহরের সিরাজউদ্দিন মিয়া বলেন,‘ গত নির্বাচনের আগে ঘনঘন হেলিকপ্টারে এলাকায় আসতো, নৌকার টিকেট নিয়ে নির্বাচন করতে খুব প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু নৌকার টিকেট বাগাতে ব্যর্থ হওয়ার পর খুব একটা চুয়াডাঙ্গামুখী হন না তিনি। তবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ইদানিং আবারও তার আনাগোণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এলাকায় নিজের পজেটিভ ইমেজ গড়ে তোলার নানা উদ্যোগ হাতে নেন দিলীপ কুমার আগরওয়াল। মায়ের নামে গড়ে তোলেন ‘তারাদেবী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন। এ সংগঠন সামাজিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি অস্বচ্ছল গর্ভবতী নারীদের অ্যাম্বুলেন্স সহযোগিতা দিয়ে থাকে। ঢাকায় অসংখ্য সংগঠনের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে নানা রকম পদক যেমন বাগিয়ে নিয়েছেন, তেমনি নানা পদ-পদবীতেও আসীন হয়েছেন তিনি। দিলীপ কুমার আগারওয়াল বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক, দাপটের সঙ্গেই আছেন এফবিসিসিআই সংগঠনেও।
ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগারওয়াল টাকা পয়সা খরচ করে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্টও হন। আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় শিল্প বাণিজ্য উপ-কমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালের ব্যক্তিগত কার্যালয় কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে গেলে যে কারোর চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠবে। দেশি ও ভিনদেশি মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দসহ সবার সঙ্গে জোড়া ছবি তুলে তা বাধিয়ে রেখেছেন দেয়ালে দেয়ালে। দরজার ভেতরে বাইরে অসংখ্য ছবির দৃষ্টিকটু প্রদর্শনীর মাধ্যমেই দিলীপ নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি, লম্বা হাতের জানান দিয়ে থাকেন। কথায় কথায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র‘ এর সঙ্গে গভীর সম্পর্কের কথাবার্তা প্রকাশ-প্রচারেও ভুল করেন না তিনি।
Leave a Reply