৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । রাত ২:০২ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
বিশেষ প্রতিবেদন ॥
দেখতে অনেক সুন্দরী কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পাপিয়ার নাম শুনলে কেঁপে উঠেন মোহাম্মদপুর, আদাবর এলাকার লোকজন। পুরো নাম ফারহানা আক্তার পাপিয়া। অস্ত্র ও মাদক জগতের পরিচিত মুখ তিনি। সুন্দরী তরুণীদের ব্যবহার করে ইয়াবা ব্যবসা চালায় সমগ্র রাজধানী জুড়েই পাপিয়া।
একের পর এক মামলার আসামি হয়েছেন। কারাভোগ করেছেন। জুটেছে মাদকসম্রাজ্ঞি তকমাও। শুধু পাপিয়া নন, রাজধানীজুড়ে এরকম সহস্রাধিক মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর মধ্যে দুর্ধর্ষ তিন শ’ জনের তালিকা রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে। তাদের প্রত্যেকের নামে একাধিক মামলা রয়েছে।
অভিযোগ, মামলা, গ্রেপ্তার কোনো কিছুতেই থেমে থাকে না তারা। বরং অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসা। পর্দার আড়ালে রয়েছেন তাদের আশীর্বাদদাতারা। যারা থাকেন সব অভিযোগ ও মামলার বাইরে। কিন্তু মাদক বিক্রির টাকার একটি বড় অংশ পান তারা। মাদকের ’ডিলারদের’ রয়েছে হাজার-হাজার খুচরা বিক্রেতা। খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে যায় মাদক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (উত্তর) বলেন, প্রতি ডিলারের গড়ে অর্ধশত মাঠ পর্যায়ের বিক্রেতা রয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য মাদক ব্যবসায়ীদের একটি অংশ নারী। সূত্রমতে, পাপিয়ার মতো মাদকের শত নারী ডিলার রয়েছে রাজধানীজুড়ে। দেশব্যাপী বিস্তৃত পাপিয়ার নেটওয়ার্ক।
চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা আমদানি করে আনা হয় ঢাকায়। চট্টগ্রামের হোসাইন নামে এক মাদক ব্যবসায়ী তা পৌঁছে দেয় পাপিয়ার ভাসুর রাহীর কাছে। পরবর্তীতে পাপিয়া ও তার স্বামী জয়নাল আবেদিন বাচ্চু ওরফে পাচু ওরফে জয় দু’জনে তা ছড়িয়ে দেয় মাঠ পর্যায়ে। মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, আদাবর, শ্যামলী ও মিরপুর এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের অন্যতম হোতা পাপিয়া। ঢাকা থেকে পাপিয়া চক্রের মাধ্যমে মাদক ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে।
সিটিটিসি’র (কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পাপিয়া ও পাঁচুকে লালবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার ডিসি এ তথ্য জানিয়েছেন।
দীর্ঘদিন থেকে পাপিয়ার বাসা থেকেই ইয়াবা বিক্রি করা হতো। মাদক ব্যবসার স্বার্থে মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লায় বাসা থাকলেও বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া নিতো পাপিয়া-বাচ্চু দম্পতি। ইয়াবা বিক্রির জন্য তাদের রয়েছে অন্তত অর্ধশত কর্মীবাহিনী। মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লার জয়েন্ট কোয়ার্টারের ৭/৪/এ নম্বর বাড়িটি তাদের হলেও মাদক ব্যবসার স্বার্থে বসবাস করে আদাবরের ছয় নম্বর সড়কের ১০৯ নম্বর জাপানি বাড়িতে।
মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লার আবু হানিফের মেয়ে পাপিয়া যখন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। তখনই তার প্রতি নজর পড়ে এলাকার তরুণ মাদক ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদিন বাচ্চুর। ওই সময়েই বাচ্চুর প্রেমে পড়ে পাপিয়া। একপর্যায়ে বিয়ে করে তারা। দরিদ্র পরিবারের সন্তান বাচ্চু ছোটবেলা থেকেই ছিঁচকে চুরিতে অভ্যস্ত ছিল। এক পর্যায়ে নিজের ভাইদের নিয়েই এলাকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই পরিবারের সবার পেশাই এখন মাদক ব্যবসা।
রাজধানীতে মাদকের আরেক সম্রাজ্ঞী পারভিন আক্তার। পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব সুন্দরী। অবাধে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের ব্যবসা করছে সে। রাজধানী ও বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার মাদকের হাট। এ মরণনেশার ব্যবসায় পারভিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তার বান্ধবী সাহেনা আক্তার রাশি। পারভিন-রাশি মিলে সদর-ঘাট কেরানীগঞ্জে গড়ে তুলেছে বিশাল চক্র। কেরানিগঞ্জের কালিগঞ্জ বড় মসজিদ রোডের ইউনুস বেপারী লেনের বাসিন্দা পারভিনকে এক নামেই চিনে এলাকার সবাই। পারভিনের প্রভাবের কারণে তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পান না কেউ।
সায়দাবাদের মাদক সম্রাজ্ঞী সুফি। মাদারীপুরের মেয়ে মুক্তার হোসেনের স্ত্রী সুফি দীর্ঘদিন থেকে সায়দাবাদের ওয়াসা রোডে গড়ে তুলেছে মাদকের আস্তানা। মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আমদানি করে সুফি চক্র। বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে আনে ফেন্সিডিল। একাধিক মামলা থাকলেও মাদক ব্যবসা থেকে দূরে নেই সুফি। স্বামীর হাত ধরে মাদকরাজ্যে পা রাখলেও তার নিজের পরিচিতিই বেশি।
ঢাকায় একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক এখন এই নারী। আরেক সম্রাজ্ঞীর নাম পারুল ওরফে পারভিন। কুমিল্লা সদরের খেতাশা গ্রামের আলমগীরের স্ত্রী পারভিন। যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচায় থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ওই এলাকার মাদক ব্যবসা। মাদক বহন করার জন্য তার রয়েছে ১০-১২ জন তরুণী। তারা ভ্রমণের নামে প্রায়ই কক্সবাজার ও টেকনাফে আসা-যাওয়া করে।
কৌশলে অন্তর্বাস ও জুতার সোর্ট বা হিলের ভেতরে এবং মোবাইলফোনের ভেতরে এবং কখনও কখনও নিজের ব্যাগে ইয়াবা বহন করে। কাজলা ২/২৯ নম্বর বাসাসহ একাধিক ভাড়া বাসা রয়েছে এই চক্রের। পারভিনের স্বামী শামীম এলাকায় পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। মাদক ও মানব পাচারের অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে এই চক্রের বিরুদ্ধে।
এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে নারী মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে আরো রয়েছে মোহাম্মদপুরের মাহিনা আক্তার সাথী, নার্গিস, সায়রা, রেশমা, কুলসুম, জিপু, সদরঘাট-কেরানীগঞ্জ এলাকার পারভীন, সায়দাবাদ এলাকার ময়না, শ্যামপুরের পোস্তগোলা রাজাবাড়ির হাছিনা বেগম, ইসলামবাগের ছাফি, গেণ্ডারিয়ার শিলামণি, পূর্ব রামপুরার এনএস সড়কের মর্জিনা বেগম, উত্তরার আশকোনার জ্যোতি, মনোয়ারা, কাওরানবাজারের মিনা, শাহিদা, পারভিন, নিশি, গুলশান নিকেতনের অঞ্জনা, উত্তরার বাসিন্দা এক সময়ের চলচ্চিত্রের নায়িকা নদী, লালবাগের মনোয়ারা, আনন্দবাজার বস্তির বানু, নিমতলী বস্তির সাবিনা, পারুল, মহাখালীর ইভা ও রওশন আরা, বনানীর আইরিন, কড়াইল বস্তির রিনা, বিউটি, গুলশানের মৌ, বারিধারার নাদিয়া, উত্তরার গুলবাহার, মুক্তি সহ আরও অনেকের নাম।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশনস) বলেন, ঢাকায় মাদকের অন্তত ৩০০ ডিলার পর্যায়ের ব্যবসায়ী রয়েছে। তাদের আমরা নজরদারি করছি। অনেককে বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করেছি। মাদক প্রতিরোধ করতে কঠোর আইন-প্রয়োগের পাশাপাশি সবাইকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
Leave a Reply