১৬ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ । দুপুর ২:৪৮ ।। গভঃ রেজিঃ নং- ডিএ-৬৩৪৬ ।।
স্টাফ রিপোর্টার॥
জমে উঠেছে ঢাকার ফুটপাত। এই ভরা মৌসুমে দ্বিগুণেরও বেশি, কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণ হয়ে গেছে চাঁদার অঙ্ক। হকাররা বলছেন, যেখানে ফুটপাত আছে, সেখানে দোকান আছে, আছে চাঁদাবাজরাও। তারা বলছেন, নগরীর ফুটপাতে চাঁদা তুলছে লাইনম্যান নামধারী ৫ শতাধিক চাঁদাবাজ।
হকারদের অভিযোগ, কতিপয় অসাধু পুলিশের শেল্টারে ফুটপাত থেকে এসব চাঁদা তোলা হয়। এ কারণে বন্ধ হচ্ছে না ফুটপাতের চাঁদাবাজি। তবে এ বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, ফুটপাত সিটি করপোরেশনের জায়গা, এসব জায়গায় হকার বসায় সিটি করপোরেশনের লোকজন কিংবা রাজনৈতিক লোকজন। চাঁদাবাজি করে তারা। এ বিষয়ে পুলিশের কী করণীয় আছে? ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের ডিসি বলেন, ফুটপাতকে কেন্দ্র করে অনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে বিভিন্ন মহল। আর দোষ দেওয়া হয় পুলিশের ওপর। তার দাবি, পুলিশ এ চাঁদাবাজির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়। এছাড়া পুলিশ সিটি করপোরেশনের জায়গায় হস্তক্ষেপ করে না। সিটি করপোরেশন চাইলে হকার উচ্ছেদ কিংবা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে পারে।
বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি বলেন, ঢাকা শহরে সাড়ে তিন লাখ হকার আছে। আরও লাখ দেড়েক হকার যুক্ত হয়েছে। তাদের কাছ থেকে সর্বনিু প্রতিদিন ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা নেওয়া হয়। এটা এলাকা ও আকারের ওপর নির্ভর করে। তিনি বলেন, রেট বাড়িয়ে যার কাছে যেভাবে পারছে সেভাবেই আদায় করছে লাইনম্যানরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণও বাড়ানো হয়েছে।
কারা এই চাঁদা নেন জানতে চাইলে এমএ কাশেম বলেন, কতিপয় পুলিশ, সিটি করপোরেশনের লোক এবং স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের কিছু রাজনৈতিক নেতা এসব চাঁদার টাকার ভাগ নেন। এই টাকা তোলার জন্য লাইনম্যান ও ক্যাশিয়ার আছে। লাইনম্যান ও ক্যাশিয়ার ঠিক করে দেয় পুলিশ। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের পরিবর্তন হয় না। তাদের কাজ সরকারি চাকরির মতো।
একেকজন লাইনম্যানের অধীনে একটি করে ‘ফুট’ থাকে। একটি ফুটে সর্বোচ্চ ৩০০ হকার বসতে পারে। তাদের একটি করে চৌকির জায়গা (দুই হাত বাই চার হাত) বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে ফুটপাত ছাড়াও সরাসরি রাস্তায়ও হকারদের বসতে দেওয়া হয়। আর আছে ভ্রাম্যমাণ বরাদ্দ। সরেজমিন গুলিস্তান হকার্স মার্কেট, বঙ্গবাজার, রাজধানী সুপার মার্কেট, ইসলামপুর কাপড় বাজার, কেরানীগঞ্জ কাপড় মার্কেট, রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেট, খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মালিবাগ সুপার মার্কেট, মালিবাগ বাজার, মৌচাক, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, এছাড়া মগবাজার, রামপুরা, বাড্ডা ও পুরান ঢাকার একাধিক ফুটপাত ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলছে বেশুমার চাঁদাবাজি। নামে-বেনামে বা সংগঠনের নামে নিয়মিত চাঁদা তোলা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গুলিস্তান রাস্তায় হকারদের কাছ থেকে টাকা উঠায় আমিন, মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষিণ পাশের ফুটপাত থেকে চাঁদা উঠায় ফেনসি নাসিরের সহযোগী আজাদ, সোনালী ব্যাংকের সামনের ফুটপাতে চাঁদা উঠায় মকবুল, রূপালী ব্যাংকের সামনে তাজুল ও তার ছেলে বাবলু, বলাকার সামনে নুর ইসলাম, জীবন বীমা ভবনের সামনের ফুটপাতে চাঁদা উঠায় কালা কাশেম, ফকিরাপুলে চাঁদা তুলে আনোয়ার, বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে দুম্বা রহিম, তোপখানা এলাকায় রহিম, পল্টন জিপিওর সামনে দাড়িওয়ালা সালাম, গুলিস্তানে হামদর্দের সামনে চাঁদা উঠায় জুয়াড়ি সালাম, পূর্ণিমার সামনে আক্তার ও জাহাঙ্গীর, গুলিস্তান রাজধানী হোটেলের সামনে হিন্দু বাবুল, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সামনে সুলতান, খদ্দের মার্কেটের সামনে কাদের, বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে কাদের (২), পীর ইয়ামিনী মার্কেটের সামনের ফুটপাতে লম্বা শাহজাহান, গোলাপ শাহ মাজারের সামনে ঘাওরা বাবুল, নগর ভবনের সামনে হিন্দু শাহীন, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের পাশের জুতাপট্টিতে সালেহ, কানা সিরাজ, বাবুল, সেলিম; বঙ্গভবন পার্কের পশ্চিম পাশের ফুটপাতে লম্বা হারুন ও তার শ্যালক দেলু চাঁদাবাজি করে। আর ফার্মগেটে শাহ আলম, জুতা মোবারক ও চুন্নু ফুটপাতের চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করে। নিউমার্কেটে চাঁদা উঠায় ইব্রাহিম ওরফে ইবু, সাত্তার মোল্লা, রফিক, বাচ্চু, ইসমাইল। সূত্র আরও জানায়, শুধু ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে এমন গডফাদার গুলিস্তানে চারজন, মতিঝিলে তিন, সদরঘাট এলাকায় তিন, নিউমার্কেটে তিন, ফার্মগেটে তিন, মিরপুর-১ নম্বরে দুজন, ১০ নম্বরে দুজন, উত্তরায় দুজন, বাড্ডায় দুজন ও কুড়িলে দুজন রয়েছে।
মকবুল, তাজুল, কানা সিরাজ, সেলিমসহ অন্তত ১০ জনের ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তারা ফোন রিসিভ করলেও পরিচয় পেয়েই ফোন কেটে দেয়। এরপর আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি তাদের সঙ্গে।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনের ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করে সাইফুল মোল্লা ও তার ছেলে। ফুটপাতের চাঁদা না দেওয়ায় শনিবার সাইফুল মোল্লা ও তার লোকজন শফিক নামে এক হকারকে মারধর করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এ ব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাইফুল মোল্লাকে পাওয়া যায়নি।
গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট এলাকার ফুটপাতের এক কাপড় ব্যবসায়ী বলেন, যে টাকা আয় হয়, এর বেশিরভাগই চাঁদা এবং রাস্তার অন্যান্য খরচ দিয়ে দিতে হয়। মাসে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা করে মাস শেষে আমরা ‘যেই লাউ, সেই কদু’। তিনি বলেন, সরকার যদি আমাদের জায়গা নির্ধারিত করে দিয়ে ভাড়া নিত, তাতে অনেক ভালো হতো। তার মতো আরও অন্তত ১০ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, চাঁদাবাজদের যন্ত্রণায় নিজেদের অতিষ্ঠ হওয়ার কথা। ফুটপাতের পাশাপাশি গুলিস্তান এলাকার বিভিন্ন সড়কের অর্ধেক অংশ এখন হকারদের দখলে। হকাররা জানান, জিনিসপত্র নিয়ে ফুটপাতে বসতে হলে লাইনম্যানদের মোটা অঙ্কের টাকা দিতেই হচ্ছে। চাঁদাবাজদের উৎপাতে রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। তিনশ’ টাকার চাঁদার জায়গায় ৮শ-৯শ টাকা গুনতে হচ্ছে।
ফুটপাতে চাঁদার অভিযোগ এবং উচ্ছেদ অভিযান সম্পর্কে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা জানান, ফুটপাতে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। আমরা সকালে অভিযান পরিচালনা করলেও বিকালেই নতুন করে এসব দোকান গড়ে ওঠে। আমাদের মাত্র দুজন নির্বাহী মাজিস্ট্রেট থাকায় চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত অভিযান পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, ফুটপাতে অবৈধ দোকান উচ্ছেদে সবার দায়বদ্ধতা রয়েছে। এদিকে এ বিষয়ে কথা বলতে উত্তর সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
Leave a Reply