তারিখ লোড হচ্ছে...

 ডিপিডিসির ২২ হাজার কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) অন্তত তিনটি প্রকল্পে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার অনিয়ম ও অর্থপাচারের অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দেশের বিদ্যুৎ খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতির এই অভিযোগে ঝড় উঠেছে ডিপিডিসিতে। জল্পনা-কল্পনার সঙ্গে সমালোচনাও চলছে সমানতালে। একই সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িতরা চাকরি হারানো কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ভয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছেন । ইতিমধ্যে প্রকল্পে নিয়োজিত বর্তমান ও সাবেক বেশকিছু কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী দেশছাড়ার পায়তারা চালাচ্ছেন। ডিপিডিসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, এই কাজে অনুসন্ধান করছে তিন সদস্যের তদন্ত দল। গত ৫ মে দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ডিপিডিসিকে ১৪ মে’র মধ্যে তিনটি প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট সব দরপত্র, মূল্যায়ন প্রতিবেদন, বিল, চুক্তি ও চালানপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চাহিদা মোতাবেক নথিপত্র সরবরাহের জন্য দুদকের কাছে সাত দিনের সময় চেয়েছে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ। বুধবার (২১ মে) এই বর্ধিত সময়সীমা শেষ হওয়ার কথা।

প্রকল্প তিনটি হলো- ১. পিডিএসডি প্রকল্প (বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্প) ২. স্মার্ট মিটার সহ উন্নত মিটারিং অবকাঠামো প্রকল্প ৩. জিটুজি প্রকল্প (বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প)।

গত ৫ মে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো এক অফিস আদেশে বলা হয়, জিটুজি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী ফজিলাতুন্নেসা এবং অন্যান্য কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর সহায়তায় অনিয়মের মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিক বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ও বাস্তবতাবর্জিত প্রকল্প গ্রহণ করে দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘনপূর্বক ইউরোপের পরিবর্তে চীন হতে যন্ত্রপাতি ক্রয় করে ২২ হাজার কোটি টাকা লোপাট ও হুণ্ডির মাধ্যমে দুবাইয়ে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানায়, নসরুল হামিদ বিপুর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর সহযোগিতায় ইউরোপের নামে দরপত্র দিয়ে চীন থেকে কমদামী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। প্রকল্পগুলোর মধ্যে কিছু বাস্তবতাবর্জিত ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে কেবল কমিশন আদায়ের উদ্দেশ্যে। দরপত্র প্রক্রিয়া মানা হয়নি, টার্নকি ভিত্তিতে কার্যাদেশ দেওয়া হলেও বাস্তবায়নে ছিল অসংখ্য ঘাটতি।

ডিপিডিসি সূত্রে জানা গেছে, বিগত স্বৈরাচার সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর দুই মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস ও আবুল কালাম আজাদ, ডিপিডিসির সাবেক দুই ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জিটুজি প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুর রহমানসহ একাধিক প্রভাবশালী প্রকৌশলী-কর্মকর্তা জিটুজি প্রকল্পের লুটপাটের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।

ডিপিডিসির সাধারণ প্রকৌশলীরা বলছেন, এই প্রকল্পটি (জিটুজি) ডেসকোকে নেয়ার জন্য তৎকালীন বিদ্যুৎপ্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ একাধিকবার চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু ডেসকোর তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাড়া দেননি। পরবর্তীতে এই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পটি ডিপিডিসির ওপর চেপে বসে। তাঁরা বলছেন, জিটুজি প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজই জনস্বার্থে – এমনটি কাগজ-কলমে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশের মত একটি গরিব দেশে এ ধরনের প্রকল্প উচ্চাভিলাষী, যা কেবল দেশের অর্থনীতিকে ঋণে জর্জরিত করেছে।

সাধারণ প্রকৌশলীদের অভিযোগ, মূলত প্রকল্পটি নেয়া হয়েছিল অবাধ লুটপাটের জন্য। সাবেক সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী, আমলা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা যেমন এই প্রকল্প থেকে টাকা লুটে নিয়েছে, তেমনি ফুলেফেঁপে উঠেছেন প্রকল্পে নিয়োজিত প্রকৌশলী-কর্মকর্তাদের একাংশ।

দুদক সূত্র জানায়, এই ঘটনায় বর্তমান ও সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীরা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন।

এ বিষয়ে ডিপিডিসির পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া আমরা মন্তব্য করতে পারি না।” বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে এটি হবে বিদ্যুৎ খাতের আরও একটি বড় দুর্নীতি। যা খুবই ন্যাক্কারজনক।

অভিযোগের বিষয়ে জিটুজি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ফজিলাতুন্নেসার বক্তব্য নিতে মঙ্গলবার (২০ মে) একাধিকবার মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

রূপপুর দুর্নীতির অভিযুক্ত আশরাফুল ইসলামের অদৃশ্য জাদু! একই পদে আট বছর

স্টাফ রিপোর্টার॥
গণপূর্ত অধিদপ্তরের ইলেক্ট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল (ই/এম) বিভাগ-১–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম গত আট বছর ধরে একই পদে বহাল আছেন। যেখানে সরকারি নীতিমতে নির্বাহী প্রকৌশলীদের এক জায়গায় তিন বছরের বেশি থাকা উচিত নয়, সেখানে আশরাফুল ইসলামের এই দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান শুধু নীতিমালা লঙ্ঘনই নয়, বরং এক ধরনের প্রতিষ্ঠিত প্রভাব ও দুর্নীতির জালকেই নির্দেশ করে।

২০২১ সালের ৫ আগস্ট গণপূর্ত উপদেষ্টা দপ্তর থেকে এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, তিন বছরের বেশি সময় ধরে যেসব নির্বাহী প্রকৌশলী একই পদে রয়েছেন, তাদের অবিলম্বে বদলি করতে হবে। উদ্দেশ্য ছিল অপারদর্শিতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির চক্র ভেঙে নতুন গতি আনা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ নীতির প্রয়োগ হয় অনেক ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্টভাবে। আশরাফুল ইসলাম তার পদে আছেন আট বছর ধরে, যা নিজেই হয়ে উঠেছে একটি উদাহরণ, নাকি ব্যতিক্রম, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আলোচিত দুর্নীতির মামলায় তার নাম থাকায় তার পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এখানেই বিস্ময় একজন দুর্নীতির অভিযোগপত্রভুক্ত কর্মকর্তা কীভাবে এতবছর ধরে ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বহাল থাকতে পারেন?

বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতির মামলা থাকা অবস্থায় কোনো কর্মকর্তার পদে বহাল থাকা সরকারি প্রশাসনিক নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অথচ আশরাফুল ইসলাম একই পদে থাকছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিচ্ছেন।

বহিরাগত চেহারায় ‘ক্লিন ইমেজ’ বজায় রাখা হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, দরপত্র ছাড়াই কাজ শুরু করা, কাজ শেষ হওয়ার পর টেন্ডার আহ্বান করা এসবই আশরাফুল ইসলামের ডিভিশনে অঘোষিত নীতি হিসেবে বিবেচিত।

‘প্রাক্কলন না করেই কাজ শুরু করে পরে প্রাক্কলন এবং টেন্ডার লাইভে দেন’, এমন মন্তব্য করেছেন অধিদপ্তরের একাধিক ঠিকাদার ও অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা।

এমনকি, তার নিজের দপ্তরে কর্মরত একজন জুনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুর্নীতি না করলে এখানে টিকে থাকা সম্ভব না। আশরাফ ভাই জানেন কার কাকে কোথায় লাগাতে হয়। উনি ম্যানেজিং-এর মাস্টার।

উত্তরবঙ্গীয় কোটা ও নিজস্ব প্রভাবের জোরে তিনি বিশেষ সুবিধাভোগী বলে অনেকের দাবি। বারবার অভিযোগ উঠলেও প্রধান প্রকৌশলী তা আমলে নেননি। বিশেষ করে সোহবানবাগ মসজিদ প্রকল্পে অনিয়মে সিভিল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে বদলি করা হলেও, আশরাফ বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

টানা ৮ বছর গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা আশরাফের মাঝে ‘সরকারই আমি’এই মনোভাব গড়ে উঠেছে বলে দাবি অনেকের। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না তার সমব্যাচের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। ফলে অধিদপ্তরে এক অদৃশ্য কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন তিনি।

আর মাত্র চার বছর পর এক যুগ পূর্ণ করবেন আশরাফ একই পদে থেকে। তখন কি বদলি হবেন? না কি নতুন কোনো রেকর্ড গড়ার পথে হাঁটবেন?

নিয়মের বাইরে অবস্থান, দুর্নীতির অভিযোগে পদোন্নতি বন্ধ থাকা, অথচ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বহাল থাকা এসব কিছুই প্রশাসনিক ব্যবস্থার দুর্বলতা ও পচন ধরা কাঠামোর প্রমাণ।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের ভেতরে ‘মিস্টার ম্যানেজার’দের ছায়া যতদিন থাকবে, ততদিন ৫ আগস্টের মত উচ্চাশী ঘোষণাগুলো কেবল ফাইলের পৃষ্ঠায় জমে থাকবে।  তবে আশরাফুল ইসলাম সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম