ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে দেশের একমাত্র আগাম শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর)। উপজেলার ৯ নম্বর সাতগাঁও ইউনিয়নের ইছামতি চা বাগানের ৫ শতাধিক বছরের প্রাচীন শ্রীশ্রী মঙ্গলচন্ডী সেবাশ্রম মন্দির প্রাঙ্গণে নয় দিনব্যাপী এই পূজায় দেবী দুর্গার নয়টি রূপের আরাধনা করা হবে। পূজা কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সোমবার প্রথম দিনে দেবী শৈলপুত্রী অনুষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয় দিনে ব্রহ্মচারিণী, তৃতীয় দিনে চন্দ্রঘন্টা, চতুর্থ দিনে কুম্মান্ডা, পঞ্চম দিনে স্কন্দমাতা, ষষ্ঠ দিনে কাত্যায়নী,
সপ্তম দিনে কালরাত্রি, অষ্টম দিনে মহাগৌরী এবং নবম দিনে দেবী সিদ্ধিদাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিটি রূপের আরাধনায় ভক্তরা ভিন্ন ভিন্ন আধ্যাত্মিক আবহ অনুভব করবেন। প্রতি বছরের মতো এবারও আগাম দুর্গাপূজায় সারাদেশের লাখো মানুষের সমাগমের প্রত্যাশা করছেন মন্দিরের পূজা উদযাপন কমিটি।

আগাম দুর্গাপূজা উদযাপন উপলক্ষে মন্দির এলাকায় সাজ সাজ রব বিরাজ করছে। স্থানীয় শিল্পীদের হাতে মনোমুগ্ধকর মন্ডপ সাজানো হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই
মন্দির প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে উঠেছে ভক্তগান, কোরাল সংগীত ও আর্চনের মাধ্যমে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও মঙ্গলচন্ডী মন্দিরে আগাম দুর্গাপূজা তাদের জন্য এক বড় আনন্দের উৎসব। পূজার পাশাপাশি প্রতিদিন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনমেলার আয়োজনও থাকবে। মন্ডপে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্থানীয় শিল্পীদের প্রদর্শনী ও ভক্তদের জন্য প্রসাদ ও খাবারের ব্যবস্থাও করা হবে।

প্রথমদিনে পূজা দেখতে আসা উপজেলার ভুনবীর ইউনিয়নের বাসিন্দা সৃষ্টি দেব বলেন, ‘আজ মায়ের প্রথম পূজো। আমরা এখানে এসেছি মাকে দর্শন করতে, মায়ের কৃপা লাভ করতে। মায়ের কাছে একটাই চাওয়া যে, আমরা যেন সবাই সব সময় ভালো থাকতে পারি। মা যেন আমাদের সুনজরে সব সময় রাখেন। আমাদের ইছামতি চা বাগানে প্রতি বছর নবদুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রতি বছর প্রচুর লোক সমাগম হয়।’ সুমিত্রা দেব বলেন, ‘মন্ডলচন্ডী মন্দিরে প্রতি বছর আগাম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এখানে প্রচুর মানুষ আনেক আগাম পূজা দেখতে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ আসেন এখানে। খুবই ভালো লাগে।’

শ্রীমঙ্গল থেকে মন্ডলচন্ডী মন্দিরে আসা শ্রাবণী তালুকদার বলেন, ‘শ্রীশ্রী মঙ্গলচন্ডী মন্দিরে আজ (২২ সেপ্টেম্বর) থেকে শুরু হয়েছে নবরূপে নবদুর্গাপূজা। অর্থাৎ দুর্গা মাকে নয়ংটি রূপে তারা এখানে পূজা করে থাকেন। আমার এখানে প্রথমবার আসার সৌভাগ্য হয়েছে। হিন্দু ধর্মের যে প্রধার ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব সেটি মূলত শুরু থাকে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী। এখানে ব্যতিক্রমধর্মী। এখানে নয় দিনব্যাপী দেবী দুর্গাকে নয়টি রূপে তার পূজা করে থাকেন। এখানে আসতে পেরে আমি খুবই আনন্দীত। আমি আমার সন্তান এবং আমার স্বামীকে নিয়ে এসেছি এখানে। মায়ের কাছে প্রার্থনা করবো জগতের সকল প্রাণীকে যেন ভালো রাখেন এবং সবার যেন মঙ্গল করেন।’

শ্রীশ্রী মঙ্গলচন্ডী সেবাশ্রম নবরূপে নবদুর্গাপূজা উদযাপন পরিষদের প্রচার সম্পাদক বুলবুল দেব বিপ্লব বলেন, ‘শ্রীশ্রী মঙ্গলচন্ডী মন্দিরটি খুবই জাগ্রত। এখানে প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবারে মায়ের পূজা হয়ে থাকে। প্রতি বছরের মতো এবারও এখানে নবরূপে নবদুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। আজকে (সোমবার) পূজার প্রথম দিন। বিজয়া দশমির আগ পর্যন্ত আরও নয়টি দেবী এভাবে পূজিত হবেন। বিজয়া দশমির দিনে পূজার সমাপ্তি হবে।’ শ্রীশ্রী মঙ্গলচন্ডী সেবাশ্রম নবরূপে নবদুর্গাপূজা উদযাপন পরিষদের সহ-সভাপতি সুরঞ্জিত দাশ বলেন, ‘শ্রীমঙ্গল উপজেলার ইছামতি চা বাগানে শ্রীশ্রী মঙ্গলচন্ডী সেবাশ্রমে চন্ডীরূপে দুর্গা মায়ের যে নয়টি রূপের বর্ণনা আছে এই বর্ণনা মোতাবেক মহালয়ার পরেরদিন থেকে আমরা নয় দিনব্যাপী মায়ের নয়টি রূপের পূজা করে থাকি। এখানে সারা বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম ঘটে থাকে। এই পূজা করতে গিয়ে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট সহযোগিতা পেয়ে থাকি। বিগত দিনেও পেয়েছি। আমরা আশা করছি এই বছরও আমরা সুচারুরূপে আমরা পূজা শেষ করতে পারবো।’

নবরূপে নবদুর্গাপূজা উদযাপনের পুরোহিত অমৃত লাল ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেবীর ৯ অবতারের প্রথম অবতার হলেন শৈলপুত্রী। বৃষ বা ষাঁড় হল তাঁর বাহন। এই কারণে তাঁকে বৃষারূঢ়াও বলা হয়। তাঁর দুই হাত। ডান হাতে ত্রিশূল ও বাম হাতে পদ্ম। সূর্যকে নিয়ন্ত্রণ করেন এই দেবী। নবরাত্রির প্রথম দিনে এই দেবীর পুজো হয়ে থাকে। এবার ২২ সেপ্টেম্বর সোমবার এই দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেবীর দ্বিতীয় অবতার হলেন ব্রহ্মচারী। বাঘের পিঠে আসীন এই দেবীর দুই হাত, ডান হাতে জপমালা ও বাম হাতে কমন্ডলু। এই দেবী বাহনহীনা। মহাদেবকে লাভ করতে দেবী ব্রহ্মচারী কঠোর তপস্য করেছিলেন। শনিকে নিয়ন্ত্রণ করেন এই দেবী। নবরাত্রির দ্বিতীয় দিনে এই দেবীর পুজো হয়। দেবীর তৃতীয় অবতার চন্দ্রঘণ্টা। তাঁর দশ হাতে ত্রিশূল, গদা, তরোয়াল, কমন্ডলু, ফুটন্ত পদ্ম, তীর, ধনুক জপমালা এবং অভয় মুদ্রা ও বরদায়ী মুদ্রা। চাঁদকে নিয়ন্ত্রণ করেন এই দেবী। নবরাত্রির তৃতীয় দিনে এই দেবীর পুজো হয়। দেবীর চতুর্থ অবতার কুশ্মান্ডা। সিংহের পিঠে আসীন এই দেবীর আট হাতে কমন্ডলু, ধনুক, বরাভয় ও কমন্ডলু, অমৃত কলস, জপমালা, গদা ও চক্র। এই দেবী বৃহস্পতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। নবরাত্রির চতুর্থ দিনে এই দেবীর পুজো হয়। দেবীর পঞ্চম অবতার হলেন স্কন্দমাতা। শিশু মুরন্ডগাঁও বা কার্তিক তাঁর কোলে। তিনি দু’হাতে কার্তিককে ধরে আছেন, অন্য দুই হাতে ফুটন্ত পদ্মফুল। এই দেবী শুভ্রবসনা। তিনি মঙ্গল গ্রহকে নিয়ন্ত্রণ করেন। নবরাত্রির পঞ্চম দিনে এই দেবীর পুজো হয়। দেবীর ষষ্ঠ অবতার হলে কাত্যায়নী। এই দেবীর চার হাত ও বাহন সিংহ। বাঁ দিকের দুই হাতে পদ্ম ও তরোয়াল এবং ডান দিকের দুই হাতে অভয় ও বরদা মুদ্রা। এই দেবী শুক্র গ্রহকে নিয়ন্ত্রণ করেন। নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে এই দেবীর পুজো হয়। দেবীর সপ্তম অবতার হলেন কালরাত্রি। ইনি ঘোর কৃষ্ণবর্ণা ও গাধার পিঠে আসীন। তাঁর দুই ডান হাতে অভয় ও বরদা মুদ্রা এবং দুই বাঁ হাতে তরোয়াল ও লোহার অস্ত্র। এই দেবী পার্বতীর সবচেয়ে ভয়ানক রূপ।

রাহুর উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে দেবী কালরাত্রির। নবরাত্রির সপ্তম দিনে এই দেবীর পুজো হয়। দেবীর অষ্টম অবতার হলেন মহাগৌরী। এর দুই ডান হাতে ত্রিশূল ও অভয় মুদ্রা। দুই বাম হাতে ডমরু ও বরদা মুদ্রা। এই দেবী শঙ্খের মতো শুভ্র। বুধ গ্রহকে নিয়ন্ত্রণ করেন ইনি। নবরাত্রির অষ্টম দিনে এই দেবীর পুজো হয়। দেবীর নবম অবতার হলেন সিদ্ধিদাত্রী। এই দেবী পদ্মের উপর আসীন। চার হাতে গদা, চক্র, পদ্ম ও শঙ্খ। ইনি ভক্তদের সিদ্ধি দান করেন। এমনকি স্বয়ং মহাদেব এঁর থেকে সিদ্ধিলাভ করেছেন। এই দেবীকে সঙ্গী করেই এই দেবীর অর্ধনারীশ্বর রূপ। কেতুর উপর প্রভাব বিস্তার করেন দেবী সিদ্ধিদাত্রী। নবরাত্রির নবম দিনে এই দেবীর পুজো হয়।’

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভাষা পরিবর্তন করুন »