তারিখ লোড হচ্ছে...

দারাজে অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে ওয়াকিটকি

নিজস্ব প্রতিবেদক॥

এবার  দারাজে রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তার জন্য স্পর্শকাতর ওয়াকিটকি ও বেজ রেডিও বিক্রি হচ্ছে। অনুমতি ছাড়া এসব ওপেন ফ্রিকোয়েন্সির টু ওয়ে রেডিও বিক্রি অবৈধ বলছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমনকি সাধারণের অবাধে এই বেতার যন্ত্র ও সরঞ্জামাদি বিক্রি ও ব্যবহার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কেননা এসব রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি সরকারি বাহিনীগুলোর ব্যবহৃত রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সিতে ইন্টারফেয়ারেন্স তৈরি করতে পারে।

সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, দুর্যোগকালে ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধারকাজে নিয়োজিত সংস্থাগুলোকে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহারের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বিটিআরসির তালিকাভুক্ত শৌখিন রেডিও অপারেটর বা অ্যামেচার রেডিও অপারেটররাও বেতার তরঙ্গ ব্যবহারের অনুমতি পান। এ ছাড়া গুরুত্ব অনুযায়ী লাইসেন্স নিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করতে পারেন।

কিন্তু এসব বেতারযন্ত্র আমদানি, কেনা বা বিক্রির জন্য বিটিআরসির লাইসেন্স ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে ছাড়পত্র (এনওসি) প্রয়োজন হয়। এমনকি যিনি কিনবেন তার জন্য সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমতি বাধ্যতামূলক। এসব রেডিও কেনা বা আমদানি করতে হয় কমিশনের তালিকাভূক্ত ভেন্ডরের (বিক্রেতা) মাধ্যমে। এর বাইরে রেডিও কেনাবেচা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

সরকারের এত সব নিয়ম-কানুন এড়িয়েই ওপেন ফ্রিকোয়েন্সির ওয়াকিটকি এবং বেজ রেডিও কেনাবেচা হচ্ছে ই-কমার্স প্লাটফর্ম দারাজ ডটকম ডট বিডিতে। ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে বেশ কিছু টু ওয়ে রেডিও, বেজ রেডিও ও বিভিন্ন বেতার সরঞ্জাম বিক্রির জন্য প্রদর্শিত হতে দেখা গেছে।

দারাজের ওয়েবসাইটে ওয়াকিটকি (টু ওয়ে রেডিও), বেজ রেডিও, ফ্রিকোয়েন্সি কাউন্টার, সফটওয়্যার ডিফাইন রেডিও এবং এর নানা সরঞ্জামাদি দেখা গেছে। দারাজের এসব ভেন্ডরের বেশির ভাগই ওভারসিজ ভেন্ডর বা বিদেশি বিক্রেতা। তাদের এসব রেডিও সরঞ্জামাদি দেশে বিক্রির অনুমতি নেই। তারপরও কাজটি করছে অবাধে।

‘প্রাইম পয়েন্ট’ নামের দারাজের এক সেলার বাওফ্যাংয়ের এক জোড়া ওয়াকিটকি বিক্রির জন্য প্রদর্শন করছে, যার দাম ৮৫২৬ টাকা। `Boyouyoushop’ নামের এক সোলারের এক জোড়া ৩-৫ কিলোমিটার রেঞ্জের টু ওয়ে রেডিওর দাম দেখাচ্ছে ২২২২ টাকা।

এ ছাড়া ফ্রিকোয়েন্সি কাউন্টার মিটারও পাওয়া যাচ্ছে দারাজে। এই মিটার দিয়ে আশপাশের সব ফ্রিকোয়েন্সি খোঁজা এবং পরিমাপ করা যায়। এর দাম দেখানো হচ্ছে ৪৯১৭ টাকা। এটি বিক্রির জন্য প্রদর্শন করছে মি গ্লোব্লা নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

‘XHHDQES’ নামের সেলার দারাজে বিক্রি করছে মিনি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি মিটার। দাম ১৯৮০ টাকা। ‘The Old Tree’ নামের বিদেশি সেলার দারাজে ৭৪৯৯ টাকায় ২৫ ওয়াটের বেজ রেডিও বিক্রি করছে। এটি একটি ডুয়েল ব্যান্ডের ইউএইচএফ/ভিএইচএফ রেডিও। এসব রেডিও সাধারণত বেজ স্টেশনের কাজে লাগে।

দারাজ সার্চ করলে এই ধরনের অসংখ্য ওয়াকিটকি ও বেজ রেডিও কেনার লিংক মেলে। অনুমতি ছাড়াই এসব রেডিও কেনা যাচ্ছে, যা কিনা আইনবিরোধী।

‘Cacao (Shenzhen)’ নামের একটি সেলার লং রেঞ্জের বিজ্ঞাপন দিয়ে বেজ রেডিও বিক্রি করছে। এসব রেডিও ওপেন ফ্রিকোয়েন্সির। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে টিউন করা নেই। স্ক্র্যান দিয়ে যেকোনো ফ্রিকোয়েন্সিতে সিগন্যাল ট্রান্সমিশন ও রিসিভ করা যায়। দারাজে প্রদর্শিত পণ্যের বিবরণে এসব তথ্য দেওয়া আছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এসব রেডিও এবং রেডিও ডিভাইস বিক্রি হচ্ছে যার-তার কাছে।

ওয়াকিটকি ছাড়াও দারাজে বিক্রি হচ্ছে ওয়াকিটকির অ্যান্টেনা, ব্যাটারি, চার্জার, হেডফোন, মাইক্রোফোন, সফটওয়্যার ডিফাইন রেডিও ইত্যাদি। দারাজে প্রদর্শিত ওয়াকিটকি এবং বেজ রেডিওর বিবরণীতে এর ফ্রিকোয়েন্সি রেঞ্জ হিসাবে বলা হয়েছে আল্ট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে (ইউএইচএফ) রেঞ্জ ৪০০-৪৭০ মেগাহার্জ। ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সিতে (ভিএইচএফ) রেঞ্জ ১৩৬-১৭৪ মেগাহার্জ। অর্থাৎ ভিএইচএফ এবং ইউএইচএফ ফ্রিকোয়েন্সিতে লম্বা একটা রেঞ্জ রয়েছে এসব রেডিওতে।

বিটিআরসির লাইসেন্সপ্রাপ্ত অ্যামেচার রেডিও অপারেটর এবং আইনজীবী তানভীর হাসান বলেন, বাংলাদেশে টু ওয়ে রেডিও বিক্রি করতে পারে কেবল বিটিআরসির তালিকাভূক্ত প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে রেডিও কিনতে বিটিআরসি থেকে প্রাপ্ত লাইসেন্স এবং রেডিও কেনার ছাড়পত্র (এনওসি) থাকতে হয়। কিন্তু দারাজ বা দারাজের সেলার ক্রেতার কাছ থেকে কোনোরূপ লাইসেন্স ও ছাড়পত্র (এনওসি) না নিয়ে সরাসরি বিক্রি করছে। এটা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। যেসব টু ওয়ে রেডিও বিক্রি হচ্ছে দারাজে, সেগুলো ওপেন ফ্রিকোয়েন্সির। এগুলো অবাধে বিক্রি ও ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয়।

এসব রেডিও না কেনার পরামর্শ দিয়ে তানভীর হাসান বলেন, লাইসেন্স ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কারও কাছে এসব রেডিও পেলে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে।

বিটিআরসির আইন বলছে অবৈধভাবে রেডিও তরঙ্গের ব্যবহারের সাজা ১০০ কোটি টাকা জরিমানা এবং ১০ বছরের জেল।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, যাদের রেডিও তরঙ্গ ব্যবহারের লাইসেন্স আছে তারাই কেবল এ ধরনের রেডিও কিনতে ও ব্যবহার করতে পারবে। এর বাইরে অনুমোদন ছাড়া বেতারযন্ত্র দিয়ে তরঙ্গ ব্যবহার নিষিদ্ধ। বিটিআরসি প্রায়ই র‌্যাবকে সঙ্গে নিয়ে অবৈধ রেডিও ও এই ধরনের যন্ত্রাংশের অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করে থাকে।

বিটিআরসির তালিকাভূক্ত রেডিও আমদানিকারক এবং বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান অলিওফিন্স করপোরেশনের প্রোপাইটর আবদুল্লাহ আল সাব্বির বলেন, টু ওয়ে রেডিও ইকুইপমেন্ট বিক্রি নিষিদ্ধ নয়। তবে শর্তসাপেক্ষে বিক্রি করার নিয়ম। একজন ক্রেতা চাইলেই তার কাছে রেডিও ও এর সরঞ্জাম বিক্রি করার বিধান নেই। তার কাছে বেতার যন্ত্রাংশ ব্যবহারে বিটিআরসির লাইসেন্স ও কেনার ছাড়পত্র আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে বিক্রেতাকে।

দেশে অ্যামেচার রেডিও অপারেটরদের শীর্ষ সংগঠন অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি অব বাংলাদেশের সহকারী সম্পাদক সৈয়দ সামসুল আলম দীর্ঘদিন অ্যামেচার রেডিও অপারেশন এবং প্রচারে কাজ করছেন। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও বিটিআরসি নানা কাজে রেডিও তরঙ্গ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো অ্যামেচার রেডিও এবং প্রাইভেট মোবাইল রেডিও (পিএমআর)। এসব রেডিও লাইসেন্স দেয়ার সময় সরকার ফ্রিকোয়েন্সি সীমা বেঁধে দেয়। এক ফ্রিকোয়েন্সির লাইসেন্স নিয়ে অন্য ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয়। এসব রেডিও কেনার জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্সের পাশাপাশি ছাড়পত্র (এনওসি) নিতে হয়। লাইসেন্স ছাড়া রেডিও কেনা-বেচা অপরাধ। এটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকিও বটে।

অবৈধভাবে ওয়াকিটকি বিক্রি করা আইনবিরোধী বলে জানিয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বিটিআরসি এই ধরনের অবৈধ কাজের বিরুদ্ধে সব সময়ই অভিযান চালায়। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নিই। অনেকে নিয়ম না মেনে অবৈধভাবে ওয়াকিটকি বিক্রি করছে। এটি তারা করছে গোপনে, যা আইনের বিরোধী। আমাদের কাছে সুস্পষ্ট অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিব।’

এ বিষয়ে দারাজের বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিউকেশন ম্যানেজার সায়ন্তনী তিশার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি এ ব্যাপারে তার প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য জানতে এজেন্সি ফোর থট পিআরের কাছে লিখিত প্রশ্ন পাঠাতে বলেন।

ফোরথট পিআরের কাছে ই-মেইল মারফত বক্তব্য জানতে চাইলে তারা জানায়, এ ধরনের যন্ত্র আগে বিক্রি হতো, এখন হয় না। এখন এমন বেতারযন্ত্র দারাজে বিক্রির প্রমাণ দেখাতে পারলে তারা এ ব্যাপারে বক্তব্য দেবেন।

কিন্তু দারাজের ওয়েবসাইট সার্চ করে এ ধরনের বেশ কিছু টু ওয়ে রেডিও বিক্রির জন্য প্রদর্শিত হতে দেখা যায়, যার স্ক্রিনশট ও লিঙ্কও আমাদের কাছে আছে।

 

ডিপিডিসির ৬ কর্মকর্তা দুর্নীতি করেও বহাল তবিয়তে

স্টাফ রিপোর্টার:

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে (ডিপিডিসি) অনিয়ম ও দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে ঊর্ধ্বতন ছয় কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালীদের আশকারায় এরা একেকজন হয়ে ওঠেন গডফাদার। বিষ্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এত অনিয়ম ও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন তারা। যদিও নিয়োগবাণিজ্য, পদোন্নতিবাণিজ্য, টেন্ডারসহ অনিয়ম-দুর্নীতি করে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন, এসব অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

ডিপিডিসির এ কর্মকর্তারা হলেন- নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) মো. গোলাম মোস্তফা, নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন্স) কিউ এম শফিকুল ইসলাম, জিটুজি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাজিবুল হাদী ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) নিহার রঞ্জন সরকার, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. কাওসার আমির আলী। খোঁজ নিলে এদের অবৈধ সম্পদের পাহাড় খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন অনেকেই। খবর নিয়ে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির আরও বেশকিছু কর্মকর্তাও এই অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। তারা হলেন, নির্বাহী পরিচালক (এইচআর) সোনামণি চাকমা, সাবেক কোম্পানি সচিব আসাদুজ্জামান, প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম ও বনশ্রী ডিভিশনের সিনিয়র সহকারী হিসাবরক্ষক মো. জসিমউদ্দিন। কোম্পানিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ এনে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করে বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ। সম্মেলনে বলা হয়, এই কর্মকর্তারা বিগত স্বৈরাচার সরকারের মদতপুষ্ট হয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সম্পদ আত্মসাৎ করেছেন, যা বর্তমান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার পরিপন্থি এবং শহীদদের সঙ্গে চরম প্রতারণা। ওই সংবাদ সম্মেলন থেকে দ্রুততম সময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের ডিপিডিসির গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অপসারণ, দুর্নীতির তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা, শাস্তি নিশ্চিতকরণ ও লোপাটকৃত অর্থ যৌক্তিক সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানানো হয়। এছাড়াও বিগত সরকার আমলে সংস্থাটির পদোন্নতিবঞ্চিত সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের উপযুক্ত পদে পদায়নেরও দাবি জানিয়েছেন তারা। তাদের অনিয়ম আর দুর্নীতির বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে একাধিক চিঠিও দেয় বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ।
জানা গেছে, সীমাহীন অভিযোগে অভিযুক্ত ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) মো. গোলাম মোস্তফা। সূত্র জানায়, গোলাম মোস্তফা গত ৯ বছরে অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। বদলি, নিয়োগবাণিজ্য এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে দেড়শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, অর্থের বিনিময়ে এবং প্রভাব খাটিয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন কোম্পানিটির বড় বড় পদপদবি। কখনো হয়েছেন অতিরিক্ত পরিচালক (এইচ আর) আবার কখনো হয়েছেন অতিরিক্ত পরিচালক (আইসিটি)। এছাড়া কোম্পানির এইচ আর পদেও অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিয়োগ, বদলি, প্রমোশন, সিএসএস ও ঠিকাদারের জনবল নিয়োগ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন ১২০ কোটি টাকা। গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে বেনামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া এবং একটি বেসরকারি ব্যাংকে ডিপিডিসির ৪০ কোটি টাকা এফডিআর করে ব্যক্তিগতভাবে কোটি টাকার সুবিধা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
দুদকের সূত্র মতে, গোলাম মোস্তফা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করেন ডিপিডিসির পরিচালকদের গাড়ি। রাজধানীর বনশ্রীতে রয়েছে তিনটি বাড়ি। স্ত্রীর নামে পূর্বাচলে বরাদ্দ নিয়েছেন ৫ কাঠার প্লট। এছাড়াও যমুনা ফিউচার পার্কে রয়েছে ৫টি দোকান ও গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় রয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ। তার অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চেয়ে বারবার মুঠোফোনে ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা আরেক কর্মকর্তা ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) কিউ এম শফিকুল ইসলাম। সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান দুই বছরের জন্য কিউ এম শফিকুল ইসলামকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন। গত ২৯ জানুয়ারি নিয়োগ পেয়েই ডিপিডিসিতে ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করেন তিনি। ডিপিডিসির ডিএসএস, সিএসএস ঠিকাদার নিয়োগ, গ্রাহকের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ, নীতিমালা ভঙ্গ করে বিদ্যুৎ সংযোগ ও বদলি-বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করেন তিনি। ডিপিডিসিতে এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা হলেন- কামরাঙ্গীরচর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী এহসানুজ্জামান, মুগদা ভিডিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মুনসুর, মগবাজারের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নাসির, শীতলক্ষ্যা ডিভিশনের গোলাম মোর্শেদ, ধানমন্ডির ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আ ন ম মোস্তফা কামাল প্রমুখ। ডিপিডিসির এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘তদন্ত দাবি করে’ সবশেষ গত ৫ সেপ্টেম্বর আবারও দুদকে চিঠি দিয়েছেন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) প্রকৌশলীরা।
প্রকৌশলীদের পক্ষে জনৈক হাবিবুর রহমান চিঠিতে এই অভিযোগ করেন। বছরের শুরুতে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের একটি প্রকল্পের পরিচালক থেকে শফিকুল ইসলামকে ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। দুদকে করা অভিযোগে বলা হয়, বিশাল অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে তাকে সরকারের একজন সিনিয়র সচিব এই পদে নিয়োগ দেন। এখন তিনি ডিপিডিসিতে বদলি, পদোন্নতি ও নিয়োগ-বাণিজ্য করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে শফিকুল ইসলাম বলেন কর্পক্ষকের কাছে জানতে চান আমি কিছু বলবো না অভিযোগ রযেছে হাসিনা সরকারের আমলে তাকে সাংবাদিক মন্তব্য জানতে ফোন দিলে প্রশাসনের লোক দিয়ে হয়রানী করতো বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগের অন্ত নেই ডিপিডিসির জিটুজি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাজিবুল হাদীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে- কর্মজীবনের ১৬ বছরে হয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক। যেখানেই দায়িত্ব পালন করেন সেখানেই গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে অর্থের লোভে চীনাদের হয়ে কাজ করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সূত্র জানায়, যোগ্য ঠিকাদারের পরিবর্তে অযোগ্যদের দিয়ে কাজ করিয়ে হাতিয়ে নেন বিপুল টাকা। রাজিবুল হাদী ডিপিডিসির খিলগাঁও ডিভিশনের প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় কুড়িয়েছেন মেলা অভিযোগ। জানা যায়, গ্রাহকদের সঙ্গে অসদাচরণ, হয়রানি এবং নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে করতেন নানা টালবাহানা। ঘুষ না দিলে মিলত না বিদ্যুৎ সংযোগ। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ বিলের কিস্তি করাতে গেলে সেখানেও তিনি উৎকোচ দাবি করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পতিত স্বৈরাচার সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ছত্রছায়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বলেও অভিযোগ করেছে বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, হাদী চাইনিজ বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন নকশা, ড্রইং ডিজাইন করে দেন।
ডিজাইনে হেরফের করে প্রকল্পের শত শত কোটি টাকা অপচয় করেন। সিনম নামে একটি চাইনিজ কোম্পানিকে দুইশ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেতেও সহায়তা করেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। বিনিময়ে সেখান থেকে ৫ শতাংশ বাগিয়ে নেন হাদী। অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাজিবুল হাদীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

অভিযোগের পাহাড় ডিপিডিসির আরেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। ডিপিডিসির বনশ্রীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী সব ধরনের শর্ত পূরণ করা হলেও টাকা ছাড়া দেন না সংযোগ। অভিযোগ রয়েছে অনিয়ম থাকলেও টাকা পেলে সব বৈধ করে সংযোগ দেন তিনি। এক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনাকেও তোয়াক্কা করেন না তিনি। সূত্র জানায়, বনশ্রীর একটি প্রপার্টিজ কোম্পানির পরিচালকের কাছ থেকে ১০ তলা ভবনের জন্য মোটা অংকের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নতুন সংযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেক্ষেত্রেও মানেননি কোনো নিয়ম কানুন। অভিযোগ রয়েছে, ভবনের প্রয়োজনীয় এবং চাহিদা অনুযায়ী ৪৫টি ফ্ল্যাটের জন্য ৩২৭ কিলোওয়াট লোডের আবশ্যকতা রয়েছে। কিন্তু নথিপত্রে লোডের চাহিদা দেখানো হয়েছে মাত্র ২৪৪ কিলোওয়াট।

অর্থাৎ লোড কম দেখিয়ে ডিপিডিসিকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন তিনি। অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মোস্তাফিজুর রহমান  বলেন, কোনো কাজের অনুমোদন আমি নিজে দিতে পারি না এবং অনুমোদনকারী কর্মকর্তা না ও উপস্থাপনকারীও না। এসব অভিযোগের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
ডিপিডিসির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও ডেসকোর সাবেক এমডি কাওসার আমীর আলীর বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। অভিযোগ রয়েছে, কাওসার আমীর আলীর সিন্ডিকেট এবং দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে ডেসকো আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দেশের এই আর্থিক সংকটের মধ্যেও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। জানা যায়, ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পর চার বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ২০০ কোটি টাকার ওপর। ঢাকার ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে একাধিক প্লট ও বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। সূত্র জানায়, কাওসার আমীর আলীর দুবাইতেও রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। পরিবারের সদস্যদের নামে রাজধানীর পূর্বাচলে রয়েছে অর্ধশত কোটি টাকা মূল্যের জমি ও প্লট। তবে এসব অভিযোগের ব্যাপারে কাওসার আমীর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগের কমতি নেই ডিপিডিসির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার নিহার রঞ্জন সরকারের বিরুদ্ধেও।
জানা যায়, বদলি-বাণিজ্যের মূলহোতা তিনি। নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি প্রতি সেক্টরেই বিপুল পরিমাণ ঘুষ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি  বলেন, আমি এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে পারব না, কেন পারবেন না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে কথা বলতে আমার ডিপার্টমেন্টের অনুমতি লাগবে। ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে ডিপার্টমেন্টের অনুমতি লাগবে কেন- এমন প্রশ্নেও তিনি একই কথা বলেন।
ডিপিডিসিতে এমন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ক্যাবের সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুর আলম বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদের ব্যাপারে সরকার পদক্ষেপ নেবে। সরকার এখনও রিফর্মের কাজ শুরু করেনি, আশা করছি সরকার রিফর্মের কাজ শুরু করলে সব সমাধান হয়ে যাবে। তাতে একটু সময় লাগতে পারে। এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বৈষম্যবিরোধী প্রকৌশলী পরিষদের প্রতিনিধি জিহাদুল হক  বলেন, বিগত সরকারের আমলে এরা বিভিন্নভাবে লুটপাট করে খেয়েছে। সৎ কর্মকর্তাদের পদবঞ্চিত করে রেখেছে। আমরা দ্রুতই এদের অপসারণ চাই।

language Change
সংবাদ শিরোনাম