চিহ্নিত মাদক কারবারি পেপার সানি হত্যা মামলার আসামি গ্রেফতার, এরপর কি?

স্টাফ রিপোর্টারঃ

রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকায় চিহ্নিত মাদক কারবারি রাকিবুল হাসান সানি ওরফে পেপার সানি (২৯) নামের এক যুবককে গত ১০ জুন গলা কেটে হত্যা করা হয়। তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মৃত হিসেবে পাওয়া যায়। এরই মধ্যে কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করেছে পল্লবী থানা পুলিশ। সোমবার (২৩ জুন) তাদেরকে আদালতে চালান করা হয়।

তবে এই মাদক ব্যবসায়ের বিরোধ থেকে খুন হওয়া পেপার সানির মামলার মোড় যেনো জটলার মতো ঘুরছেই। ১০ জুন সকালে পল্লবীর মিরপুর ১১, মিল্লাত ক্যাম্পের (বি-ব্লক) ৩ নম্বর লাইনে সানিকে হত্যা করা হয়। নিহত পেপার সানিকে অনেকেই ইয়াবা সানি নামেও জানতো। অন্যান্য আসামিদের মধ্যে সম্প্রতি মিরপুর ১১ আলুপট্টি থেকে ইমরান, বৌ বাজার থেকে পারভেজ, এবং মিরপুরে মাদক-সন্ত্রাসের অন্যতম গটফাদার রাসেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে অনেকেই।

স্থানীয় সূত্র বলছে, রাসেল ও তার দুই ভাই তোফায়েল ওরফে কানা তোফায়েল, সানজু এরা তিন ভাই মিলে মাদক সম্রাজ্য চালায়। আর তাকে সাহায্য করে ওই এলাকার অনেকেই। তার মধ্যে ওই লাইনের রোকি অন্যতম। এমনকি রোকি পেপার সানি হত্যা মামলাতেও জড়িত।

অভিযুক্ত রাসেলের পাপের দাস্তান অনেক লম্বা। পরিচয় গোপন রেখে স্থানীয়রা জানান, “পল্লবী থানায় রাসেলের নামে মাদক চোরাচালান, কিশোরগ্যাং সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এমনকি পল্লবী থানায় পুলিশ হেফাজতে মিরপুরের জনি হত্যা মামলায়ও রাসেলর নাম রয়েছে। ওই সময়ে রাসেল পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতো। ধীরে ধীরে পুলিশের ছত্রছায়ায় রাসেল মাদক কারবারি হয়ে ওঠে। সে ডুইপ প্লটের মাদক সম্রাট হেরোইন মোস্তাকের সাথে প্রতিযোগিতা করে মাদকের ব্যবসা করে।”

নিহত সানি কালশীর মোহাম্মদ সোহেলের ছেলে। তিনি স্ত্রীসহ মা-বাবার সঙ্গে ওই এলাকায় বসবাস করতেন। ঘটনার দিন নিহতের বাবা মোহাম্মদ সোহেল অভিযোগ করে বলেন- ‘জিন্দা, টানা আকাশ, রুবেল, বোমা কাল্লু, কাসরা সোহেলসহ কিশোর গ্যাং গ্রুপের সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করেছে। পরে ঘটনাস্থলেই মরদেহ ফেলে পালিয়ে যায় ওরা।’

নিহতের বাবার দাবি, ওই কিশোর গ্যাং গ্রুপকে এলাকার সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও মাদক কারবারে বাধা দেওয়ার কারণে ওরা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে।

তবে স্থানীয় সূত্রে জানায়, ‘মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সানির সঙ্গে ওই কিশোর গ্যাংয়ের সন্ত্রাসীদের দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিল। এই কারণে ওইদিন সকালে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটায়। নিহত সানি দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা কারবারির সাথে জড়িত। সম্ভবত কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ এবং মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই সে খুন হয়েছে। কারণ মিরপুরের প্রতিটি বিহারি ক্যাম্পেই মাদকের রমরমা ব্যবসা চলছে। এসব নিয়ে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি শহীদ জিয়া মহিলা ডিগ্রী কলেজের পাশে যে খুন হয়, ওই মার্ডারও পেপার সানি করে।’

সোমবার (২৩ জুন) আটককৃত আসামিদের বিষয়ে জানতে পল্লবী থানায় উপস্থিত হয় আমরা। পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিউল আলম বা ওসি তদন্ত কাউকেই থানায় পাওয়া যায়নি। থানা থেকে বলা হয়, সকলেই মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতে গেছেন। উক্ত মামলার তদন্ত অফিসার এসআই হুমায়ুন’কে একাধিবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। পরে থানা থেকে আটককৃত দের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।

তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ভুক্তভোগী পারভেজের পরিবারের অভিযোগ, ‘মার্ডার মামলার আসামি রাসেল মিরপুরে মাদক গডফাদারদের মধ্যে অন্যতম। তার কারণেই পারভেজের এই পরিণতি, পারভেজকে ফাঁসানো হয়েছে। রাসেলের কঠিন শাস্তি হলে অন্য সবাই সতর্ক হবে।

পরিচয় গোপন রেখে মামলা সম্পর্কে ভয়াবহ তথ্য দেন স্থানীয় কয়েকজন। তাদের ভাষ্যমতে, “মিরপুর ১১ বড়ো মসজিদের পাশে (বৌউ বাজার), বি ব্লকের ৮ নাম্বার লাইনে রাসেল থাকে। রাসেলের ২ ভাই, ডুইপ প্লটের হেরোইন মোস্তাক, মোস্তাকের প্রতিটি ছেলেই মাদক কারবারির সাথে যুক্ত, বিশেষ করে সুমন, সাইমন, মামুন সহ সবাই, ওখানকার রোকি, মিরপুর ১১ স্বর্নপট্টি সংলগ্ন এফজি ক্যাম্পের ইয়াবা সাব্বির, তার ভাগ্নে ইয়াবা আসিফ ওরফে সেকেন্ড থানা, নিলয় সহ প্রায় ২০ জন এই এলাকায় মাদকের ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছে। তারা প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করে। অথচ পুলিশ কিছুই করে না।”

মিরপুর ১১ সি ব্লক, স্বর্নপট্টি এলাকার কয়েকজনের সাথে কথা হয়। তাদের ভাষ্যও একইরকম। তবে তাদের অভিযোগ আরও গুরুতর। স্থানীয়দের অভিযোগ, “এই এলাকায় মাদকের পাইকারি ব্যবসায়ী বৌ বাজারের রাসেল, ডুইপের মোস্তাক মিয়া ও তার ছেলেরা, স্বর্নপট্টি এলাকায় বিহারি সাব্বির, আসিফ, আসিফের বোন শারমিন। আর বাকি যে নামগুলো শুনলেন, ওরা খুচরা বিক্রি করে। তবে এদেরকে কেউ ভয়ে কিছু বলে না। কারণ ডুইপের হেরোইন মোস্তাকের ২২ টা বাড়ি- টাকার অভাব নেই। আর আসিফ নিজেকে সেকেন্ড থানা বলে পরিচয় দেয়। পল্লবী থানা পুলিশ নাকি ওর দুলাভাই-আত্নীয়। এমনকি শারমিন নিজে সরাসরি দেহব্যবসা ও মাদক ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। এই শারমিন পল্লবী থানার পুলিশকে রুমে গোপনে সার্ভিস দিয়েই সবকিছু লিয়াজু করে। এমনকি শারমিন সাবেক এমপি ইলিয়াস মোল্লার রক্ষিতা বলেও সবাই জানে। শারমিন বিভিন্ন এলাকায় সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে হানি ট্রাপের ফাঁদ তৈরি করে। তার অনেক ক্ষমতা। এজন্যই ভয়ে কেউ কোনো কথা বলে না।”

এই পেপার সানি হত্যা মামলার বিষয়ে নতুন করে আরেকটি অভিযোগ আসে। স্থানীয় ও কিছু ভুক্তভোগী পরিবারের দাবি, ‘নিহত সানির মা রাসেলের থেকে ৫ লক্ষ টাকা খেয়ে মামলার মোড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিতে চাচ্ছে। অথচ এই রাসেল, মোস্তাক, আসিফ গং পুরো মিরপুরে মাদকের অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছে। এমনকি নিহত সানির বাবা-মা পুলিশের কাছে অনেকের নামও বলেনি। এভাবেই বড় মাফিয়ারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। কারণ নিহত পেপার সানি জীবদ্দশায় ইয়াবার ব্যাবসা করতো, খুন-জখম সহ বিভিন্ন অপকর্ম করতো। পেপার সানির নামে খোঁজ নিলে বিভিন্ন থানায় মামলাও পাবেন। অথচ পেপার সানির মা এসব গোপন রেখে ছেলেকে উস্কে দিতো।’

তবে রাসেল বা কারো কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে বারংবার ফোন করা হলেও নিহত পেপার সানির মা অথবা স্ত্রী ফোনকল রিসিভ করেন নি।

সবমিলিয়ে রাজধানী তথা মিরপুরে মাদকের রমরমা ব্যবসায়ের যেনো কোনো থামার ইঙ্গিত নেই। কয়েকজন বড় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রায় শতাধিক মাদক কারবারি দেদারসে মাদকের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়- এই মাদকের রমরমা ব্যবসা, কিশোর গ্যাং, নানাবিধ কোন্দলে খুন সহ অসংখ্য অপরাধের স্বর্গরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে মিরপুর ১১ তথা পল্লবীতে প্রশাসন শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না।

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম