
* ৫ আগস্টের পর পলাতক সাইফুল, স্থবির কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন কাজ * দুর্নীতি করে শত কোটি টাকার মালিক, কাজ না করেই নিয়েছে বিল
* ৫ থেকে ২০ পার্সেন্টে বেঁচে দিয়েছে ৫০ কোটি টাকার কাজ * ব্যবস্থা নিতে দুদকে অভিযোগ
নিজস্ব প্রতিবেদক॥
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক না থাকার পরও এন এস গ্যালারীর স্বত্ত্বাধীকারি সাইফুল ইসলাম ছিলেন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সকল ঠিকাদারি কাজের প্রধান নিয়ন্ত্রক। সাইফুলকে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের হাজার কোটি টাকার কাজের নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়েছিলে কুমিল্লার সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। সাইফুলের কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু হয় আরফানুল হক রিফাত মেয়র থাকা অবস্থাতেই। কুমিল্লা সিটির টেন্ডার হওয়া কাজের প্রায় ৪০ থেকে ৬০ ভাগ দেয়া হতো সাইফুলের লাইসেন্স এন এস গ্যালারীর নামে। বিগত তিনটি টেন্ডারে সাইফুল ইসলামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এন এস গ্যালারীর নামে টেন্ডার লয়েস্ট হয়েছে ১ শত ৭২ কোটি টাকার কাজ। তবে সকল কাজই এককভাবে দেখাশোনা করতের সাইফুল। যাদেরকে ভাগ করে কাজ দেওয়া হতো, তাদের কাছ থেকে নিতেন ৫ পার্সেন্ট। এছাড়াও কাজের প্রাক্কলন থেকে শুরু করে ফাইনাল বিল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন সাইফুল, সাইফুলের এই দুর্নীত ও কোটি টাকা আত্মসাতের পেছনে জড়িত রয়েছে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের উচ্চ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। যারা ৫ আগস্টের পর থেকে ভোলপাল্টে এখন অন্তর্র্বতী সরকারের গুণকীর্তন গাইছেন। যার সুবাদে সাইফুল অল্প সময়ে কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক রয়েছে। তবে সাইফুলকে কুমিল্লা সদরের সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার দায়িত্ব দিলেও মেয়র আরফানুল হক রিফাতের মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনে বাহার কন্যা তাহসীন বাহার সূচী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সাইফুল বনে যায় কুমিল্লা সিটির সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি। একটি সূত্র জানায়, কুমিল্লা সিটির টেন্ডার সহ সকল কাজের থেকে নগদ অর্থ আসার বিষয়ে অলিখিত উপদেষ্টা ছিলেন সাইফুল, মেয়র সূচীকে এবিষয়ে সব ধারণা দিতেন তিনি। মেয়রের চেয়ারে বসেই কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের কোটি টাকা ডুকতো সূচীর ভ্যানেটি ব্যাগে, তাই সূচীরও এক নাম্বার লোক হয়ে যান সাইফুল ইসলাম। ৫ আগস্টের পর থেকে ভয়ে ও আতঙ্কে থাকা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী অভিযোগ করে বলেন, কোনো দিন আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন না সাইফুল ইসলাম। তিনি হয়ে যায় কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের হর্তাকর্তা। দীর্ঘ দিনের পুরনো কর্মীদের বঞ্চিত করে লুটে নেন কুমিল্লা সিটির কোটি টাকার কাজ। অনেকে বলেন, সাবেক এমপি বাহারের দেওয়া কর্মীর কাজও সাইফুল ছলচাতুরি করে আত্মসাৎ করতেন।
অনেকের অভিযোগ আওয়ামী লীগের পুরনো কর্মীর কাজ ও টাকা আত্মসাৎ করেন নব্য আওয়ামী লীগার সাইফুল। তবে বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, সাইফুল ইসলামের এই ক্ষমতার উৎস হচ্ছে টাকা। তিনি বহু আগে থেকেই সাবেক এমপি বাহার পরিবারের সকলকে নিয়মিত টাকা দিতেন। যার সুবাদে সাইফুল হয়ে উঠেন বাহার পরিবারের কাছে বিশ্বস্ত ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি। বাহার কন্যা সূচী মেয়র হওয়ার পর পরই তিন থেকে চারটি টেন্ডারে প্রায় সাড়ে ৫শত কোটি টাকার টেন্ডার হয় কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনে। যেখান থেকে প্রায় একশত কোটি টাকার মতো কাজের টেন্ডার হয় সাইফুলের এন এস গ্যালরীর নামে। সেখান থেকে সাইফুল একাই নিতেন ৩০ কোটি টাকার কাজ। সাইফুল পলাতক হওয়ায় মুখথুবরে পরেছে কুমিল্লা সিটির উন্নয়ন প্রকল্প। এদিকে কাজ পাওয়া অনেকে জানিয়েছেন, সাইফুল পলাতক হলেও কাজের পার্সেন্টিজ নিয়মিত নিচ্ছেন তিনি। নিজের নামে নেওয়া কাজ বিক্রি করে দিচ্ছেন ১৫ থেকে ২০ পার্সেন্টে। পলাতক হয়েও কিভাবে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের টাকা আত্মসাৎ করছেন। এবিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক ও নির্বাহীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেছে একটি গ্রুপ। নামে-বেনামে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়ে তদন্ত করে সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ ও তার লাইসেন্স বাতিলের দাবি জানান ঠিকাদার ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা সহ অনেকে। ভুক্তভোগিরা কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান প্রশাসক ও নির্বাহীর কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলেন, সাইফুল ইসলাম, প্রোপ্রাইটর-এন. এস গ্যালারি. পিতা-মোঃ আঃ মালেক (তিশার ড্রাইভার), মাতা-আনোয়ার বেগম, গ্রাম-চম্পকনগর, পোঃ তালপুকুর পশ্চিম পাড়, কুমিল¬া সিটি করপোরেশন, কুমিল¬া। কুমিল¬ার সাবেক এমপি বাহাউদ্দিন বাহার, তার মেয়ে সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার সূচনা-এর যোগসাজশে তাদের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অবৈধভাবে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে, কাজ না করে বিল ভাউচার তৈরি করে, ভুয়া পে-অর্ডার বানিয়ে, ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টার হয়ে, চেক জালিয়াতি করে, ভুঁয়া মানি রিসিট তৈরি করে, আংশিক কাজ সম্পন্ন করে প্রকল্পের পুরো বিল হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্রে জানা যায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলো। নগরবাসীর প্রত্যাশা ছিল নগরীর জীর্ণ শীর্ণ সড়ক ব্রিজ কালভার্ট, ড্রেনসহ বিভিন্ন গ্রামীণ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করবেন। নগরবাসীর চলাচলে নিরাপদ সড়ক তৈরি করবেন। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নের নামে ঠিকাদার সাইফুল বাহিনী যে লুটপাট করেছে তা নজিরবিহীন। স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা যায়, কুমিল¬া সিটি কর্পোরেশনের কোনো উন্নয়ন কাজ করতে হলে আগে সাইফুলের সাথে আগে যোগাযোগ করতে হবে, তারপর অন্যান্য কর্মকর্তা। সাইফুল দাম্বিকতার সাথে বলেন, এখানে যত বাজেট বা কাজের সিডিউল সব আমার হাত থেকে হয়। তাই অন্যত্র যোগাযোগ করে কোনো লাভ নেই। যা আমি পারবো, তা অন্য কেউ পারবে না।
অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, এক সময় কুমিল্লার এমপি বাহারের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, যা বর্তমানে দখল করেছে সাইফুল বাহিনী। সাইফুলের পরিবারের একসময় নূন আনতে পানতা ফুরানোর অবস্থা ছিল। তার বাবা কুমিল্লা এলাকার তিশা গাড়ীর ড্রাইভার ছিল। সেই ড্রাইভারের ছেলে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার দোসর কুমিল্লার সাবেক এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিনের একান্ত আপনজন হিসেবে তিনি এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছেন। শেখ হাসিনার দম ফুরিয়ে গেলেও এই সাইফুলের দম ফুরায়নি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরে ক্ষমতাসীনদের বিপুল সম্পদ অর্জনের ইতিহাস তো সবারই জানা। এ অর্থ সম্পদের পাহাড় কেবল তৎকালীন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরাই গড়ে তুলেননি, তাদের অনুসারী দোসররাও সৃষ্টি করেছেন নতুন নতুন ইতিহাস, বানিয়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ গাড়ি-বাড়ি। এমপি বাহার এবং তার কন্যা তাহসিন বাহার সূচনার খুব কাছাকাছি থাকায় ছাইফুল লাগামহীন অর্থের নাগাল পেয়ে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ভুল করেননি। তাই রাতারাতি গড়ে তুলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট বাহিনী। আর অল্পদিনে দিনে গড়ে তোলেন বিলাস বহুল গাড়ি বাড়ি। ব্যাপক দুর্নীতি, কাজ না করে বিল উত্তোলন ও ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং ভাগভাটোয়ারা ও কমিশন বাণিজ্যের মূল হোতা সাইফুল ইসলাম রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, কেউ কেউ বলছেন ৫ আগস্টের পর থেকে সাইফুল দুবাই বা সিঙ্গাপুরে পালিয়ে গিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাইফুল ইসলাম দুর্নীতির মাধ্যমে যে পাহাড়সম সম্পদ গড়েছেন, তা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। সাইফুল ইসলাম সবার সাথে মিলে যে, সিন্ডিকেট বাণিজ্য করেছে তা সবার মুখে মুখে আলোচিত হলেও তার ভয়ে কেউ কখনও কিছু বলার সাহস পায় নাই। এবিষয়ে জানার জন্য কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহীকে বার বার কল দিয়েও তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।