স্টাফ রিপোর্টার॥
ঢাকার মোহাম্মদপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে কর্মরত একজন সাধারণ উমেদার—আব্দুল ছোবান। শুরু করেছিলেন মাত্র ৬০ টাকার হাজিরায়। অথচ আজ তিনি এক বিশাল সম্পদের মালিক। জমি, বাড়ি, গাড়ি—যা সাধারণ একজন সরকারি কর্মচারীর পক্ষে সম্ভব না, সেই অসাধ্যকেই সম্ভব করে তুলেছেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কীভাবে?
২৬ বছর ধরে একই অফিসে কর্মরত এই উমেদার সময়ের সাথে সাথে পুরো অফিসকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছেন। অফিসের ফাইল কার কবে যাবে, কত টাকা দিলে কোন দলিল কিভাবে সাজানো যাবে, কাকে আগে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে—সবই নির্ধারণ করে তার সিন্ডিকেট। এমনকি সাব-রেজিস্ট্রার পর্যন্ত অনেক সময় তার ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেন। অফিসের ভেতর ছোবানই শেষ কথা। শুধু চাকরি নয়, তিনি একেক সময় নিজেকে জমির দালাল, আবার কখনও রেজিস্ট্রারের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেন।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, তিনি নিজের ভাগ্নে আয়নাল হোসেনকে অফিসে নিয়োগ দিয়েছেন, যার কোনো সরকারি নিয়োগপত্র নেই। অথচ তিনিই অফিসের চাবি রাখেন, রাতের আঁধারে অফিস খুলে পুরোনো দলিল পাল্টে দেন, দাগ নম্বর বদল করেন, আর নকল কাগজ বানান। দিনের বেলায় যা সম্ভব নয়, তা রাতের অন্ধকারেই হয়ে যায়। এটা যে শুধুই বেআইনি নয়, দেশের ভূমি ব্যবস্থার ওপর ভয়ানক হুমকি—তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
এই দুর্নীতির বিনিময়ে ছোবান যা অর্জন করেছেন, তা যে কারো চক্ষু চড়কগাছ করে দেবে। বছিলায় তার ১৫ কাঠা জমি আছে যার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। আদাবরে নিজের নামে ৬ তলা বাড়ি, কাটাসুর ও সাতারকুলে আরও জমি, দক্ষিণখানে বিশাল প্লট। তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে মিনিবাস, মাইক্রোবাস, এমনকি ইজিবাইক লাইনের মালিকানা রয়েছে। দেশের বাইরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা, পরিবারসহ শপিং—সবই চলে এই ঘুষের টাকায়। শুধু অফিস থেকেই প্রতিদিন ১ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ ওঠে, মাসে যার পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়ায়।
অথচ তার আয়কর নথিতে সম্পদের হিসাব মাত্র ৭৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। এই ভুয়া তথ্য দিয়ে তিনি শুধু সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেননি, বরং পুরো সিস্টেমকে বৃদ্ধাঙ্গুলিও দেখিয়েছেন। এমনই ক্ষমতার মালিক তিনি।
এই ঘটনা তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একজন সহকারী পরিচালক ইতোমধ্যে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো শাস্তি হয়নি। বরং অফিসে যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়, তারা বদলির ভয়, হুমকি আর চাপে পড়ে মুখ বন্ধ করে দেয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, একজন উমেদার যদি পুরো ব্যবস্থাকে কিনে ফেলতে পারে, তবে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার কোথায়? সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান তাহলে কেবল বক্তৃতাতেই সীমাবদ্ধ?
এখন সময় এসেছে সাহসিকতার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার। এমন দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট যদি একবার ধরা না পড়ে, তবে শুধু মোহাম্মদপুর নয়—সারা দেশে এরা শিকড় গেড়ে বসবে। আব্দুল ছোবান একা নন, তিনি একটি চক্রের নাম, একটি সিস্টেমের প্রতিচ্ছবি। তাকে বিচারের মুখোমুখি না করা পর্যন্ত দেশের ভূমি অফিসগুলোতে সৎ কর্মকর্তারা নিরাপদ নন এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এখন সময় তার মতো দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দেওয়া এবং আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার। জনগণ তা-ই চায়।
এবিষয়ে বক্তব্য নিতে আব্দুল ছোবানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর তার ভাগ্নে আয়নাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। প্রথমে কল ধরলেও সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার কল দিলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মোহাম্মদ মাসুদ || বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ২১/১ নয়াপল্টন, ঢাকা-১০০০ || মোবাইল : ০১৫১১৯৬৩২৯৪,০১৬১১৯৬৩২৯৪ || ই- মেইল: dailysobujbangladesh@gmail.com || ওয়েব : www.dailysobujbangladesh.com
Copyright © 2025 দৈনিক সবুজ বাংলাদেশ. All rights reserved.