বান্দরবান এলজিইডিতে চলছে ঘুষের উৎসব

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥

বান্দরবান এলজিইডিতে চলছে ঘুষের উৎসব। জুন মাসকে কেন্দ্র করে ঠিকাদারী বিল প্রদানের নামে নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তাসাউরসহ অন্যান্য প্রকৌশলীরা সরকারের অর্থ বরাদ্দে ঘুষ আদায় করছে। জুন মাস সরকারী হিসাবের শেষ সময় হিসেবে ধরা হয়, এবং এই সময়েই সরকারি উন্নয়ন কাজের ফাইনাল বিল প্রদান করা হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তাসাউর ও তার সহকর্মীরা ঠিকাদারদের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ হারে ঘুষ আদায় করছেন।

এলজিইডির এক ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অনেক কাজ এখনও শেষ হয়নি, কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করে ঠিকাদাররা পুরো বিল তুলে নিচ্ছেন। এতে কাজের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। জসিম উদ্দিন নামক এক ঠিকাদার অভিযোগ করে বলেন, উন্নয়ন কাজের চেক প্রদান করতে নির্বাহী প্রকৌশলী ১৫ শতাংশ ঘুষ নেন। বিষয়টি এখনো অজানা রয়ে গেছে।

এদিকে, বান্দরবান এলজিইডির টেন্ডার নিয়েও চলছে নানা অনিয়ম। বিএনপি দুই গ্রুপ ও জামায়াতের একটি অংশ মিলে সমঝোতার মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকার উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি। আগামী ২৪ জুন ও ২৬ জুন দুটি টেন্ডারের বিজ্ঞপ্তি রয়েছে। এই ঠিকাদারি কাজ ভাগভাটোয়ারা করতেও একাধিক বৈঠক হয়েছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ঠিকাদারদের মধ্যে। এতে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী পছন্দের ঠিকাদারকে গোপন দরপত্র জানিয়ে দেন। এর বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ ঘুষ গ্রহণ করেন তিনি।

এছাড়া, প্রতি বছর সরকারের রাজস্ব আয় ফাঁকি দিতে কিছু ঠিকাদার উপজাতীয় লাইসেন্স ব্যবহার করছে। এই অপকর্মে জড়িত বান্দরবান এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী। এর ফলে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পার্বত্য রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এলজিইডির তালিকা ভুক্ত উপজাতী এবং বাঙালি মিলে প্রায় ২৫০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স রয়েছে।

পার্বত্য এলাকায় বাঙালীদের জন্য ৫% আয়কর (ইনকাম ট্যাক্স) প্রযোজ্য থাকলেও উপজাতীদের জন্য তা মওকুফ করা হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গত ১৫ বছর ধরে বান্দরবানের কিছু অসাধু বাঙালি ঠিকাদার সরকারী ৫% রাজস্ব ফাঁকি দিতে উপজাতী লাইসেন্স ব্যবহার করে কম দর দিয়ে কাজ নিয়ে যাচ্ছে। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মি. মায়াধন কন্সট্রাকশন, এমএম ট্রেডার্স, মেসার্স মিল্টন ত্রিপুরা, মি. ইউটিমং, মেসার্স মার্মা এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদি।

অভিযোগ রয়েছে, কিছু বাঙালি ঠিকাদার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে যোগসাজশ করে ৫% আয়কর ফাঁকি দিয়ে উপজাতীয় নামের লাইসেন্সে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করছে এবং কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে। এভাবে কাজ পেতে তারা নির্বাহী প্রকৌশলীকে মোটা অংকের ঘুষ দেয়। এর ফলে বহু অভিজ্ঞ ঠিকাদার এই সিন্ডিকেটের কারণে কাজ পাচ্ছেন না।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে, নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তাসাউরকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেনি।

অন্যদিকে, স্থানীয় ঠিকাদাররা দাবি করেন যে, তারা বারবার অভিযোগ দিলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাঁরা অভিযোগ করেন, “প্রকল্পগুলোর কাজ ঠিকমতো হয়নি, অথচ বিল উত্তোলন করা হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী এসব কাজের জন্য প্রকৃত ঠিকাদারদের উপেক্ষা করে গোপনে সমঝোতার মাধ্যমে অল্প কাজ করা ঠিকাদারদের কাছে কাজ পাচ্ছেন।”=

অপর দিকে, বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) খাল খনন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ৭০% বিল নিয়ে কাজের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ সম্পন্ন হয়নি। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে আলীকদম উপজেলা সদরের পানি সংকট নিরসনে ক্যায়াং ঝিড়ি খাল খনন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। প্রকল্পটির মাধ্যমে হিন্দু পাড়া, নাজির চেয়ারম্যান পাড়া, বাজার পাড়া, থানা পাড়া, আলীম উদ্দিন পাড়া, পোস্ট অফিসসহ কয়েকটি পাড়ার অন্তত ১০ হাজার মানুষ উপকৃত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজটি সম্পন্ন না হওয়ার কারণে স্থানীয় জনগণের দুর্ভোগ বেড়েছে।

এছাড়া প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৭২ লাখ টাকা, কিন্তু কাজটি এখনও শেষ হয়নি। ইউনি ব্লক স্থাপন, ওয়াকওয়ে ও বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করার কথা থাকলেও খালটি খনন করার বাইরে কিছুই করা হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে এবং খালটির দুই পাড় ভেঙ্গে পড়ে। ফলে সরকারী টাকা অপচয় ছাড়া তেমন কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে না।

এলজিইডির কর্মকর্তারা, বিশেষ করে সহকারী প্রকৌশলী জয় সেন ও উপজেলা প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ, এই প্রকল্পের তদারকি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রকল্পটির দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার মো. কায়সারের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এইসব অনিয়ম এবং দুর্নীতির কারণে বান্দরবান এলজিইডিতে উন্নয়ন কাজের মান অত্যন্ত নিম্নমানের হয়ে পড়েছে। ঠিকাদাররা সরকারের টাকা আত্মসাৎ করার জন্য নানা চক্রান্তে লিপ্ত থাকছে, যার ফলে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে না এবং স্থানীয় জনগণের দুর্ভোগ বেড়েছে। এটি সরকারের জন্য এক বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম