স্টাফ রিপোর্টার॥
রাষ্ট্রায়ত্ব অগ্রণী ব্যাংকে বছরের পর বছর ধরে চলছে ঋণ জালিয়াতির মহোৎসব। আওয়ামী সরকারের ১৬ বছরে যে জালিয়াতি ভয়ংকর রূপ ধারন করেছিলো তা ৫ আগস্টের পরেও থেমে নেই। মর্টগেজ মূল্যের কয়েকগুণ বেশি ঋণ প্রদানসহ নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি যেন ব্যাংকটির জন্য সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, আওয়ামী দোসর ও আর্থিক সহায়তাকারি ব্যবসায়িদের লুটপাট কার্যক্রম ৫ আগষ্টের পর কিছুটা কোনঠাসা হয়ে পড়লেও সম্প্রতি ব্যাংক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে তাদের ঋণ জালিয়াতি কার্যক্রম। ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখা, বিবি এভিনিও, গ্রীন রোড কর্পোরেটসহ বেশ কয়েকটি শাখায় ঋণ জালিয়াতি কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
এসব ঋণ সংক্রান্ত কাগজপত্রের তথ্যানুযায়ী, গ্রীন রোড কর্পোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ডিকে নিটওয়্যার লিমিটেডকে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ বাবদ সর্বোচ্চ ২৩৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। ডিকে নিটওয়্যারের ঋণ স্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ব্যাংকের সাথে যোগসাজশে জালিয়াতির মাধমে প্রতিষ্ঠানটি মর্টগেজের কয়েকগুণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের সুবিধার সুযোগ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে এই লুটপাট হয়ে আসছে। অবৈধ সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেনি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানটি ।
নিজেদের সুবিধামত ভুয়া মাস্টার এলসি ও কন্ট্রাক্ট এর বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক সুবিধা গ্রহণ করে বিভিন্ন সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে এক্সেসরিজ সংগ্রহ করে খোলা বাজারে বিক্রি ও টাকা পাচারের তথ্যও পাওয়া গেছে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজসে ডিকে নিটওয়্যারের এসব ব্যাক টু ব্যাক এলসির 'একসেপটেন্স বা ম্যাচুরিটি তারিখ' গ্রীন রোড শাখা থেকে প্রদান করা হয়। এসব ভুয়া কন্ট্রাক্ট বা মাস্টার এলসির বিপরীতে কোন রপ্তানি না থাকায় পরবর্তিতে ডিমান্ড লোন সৃষ্টি করে সাপ্লাইয়ারদের পেমেন্ট করতে বাধ্য হয়েছে গ্রীন রোড শাখা। চলতি বছরের ৩১ মার্চ ডিকে'র ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড দায়সমুহ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ও দ্বিতীয় ডিমান্ড লোন যথাক্রমে ১১ কোটি ৯৯ লাখ ও ৩৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা গ্রীন রোড শাখা পুনঃতফসিল করে দেয়। পরবর্তি সময় ঋণের কোনো টাকা পরিশোধ না করা সত্ত্বেও ব্যাংকটির এই শাখা ২০২৩ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে আবারো ৭০ কোটি ২০ লাখ টাকার ডিমান্ড লোন মঞ্জুর করে। এর পরেও লোনের কোনো টাকা পরিশোধ করেনি ডিকে নিটওয়্যার। অভিযোগ রয়েছে, এই টাকাও ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা ও ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানটি।
এখানেই থেমে থাকেনি লুটপাট। ২০২৪ সালে একই শাখা আবারো ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার ডিমান্ড লোন মঞ্জুর করে ডিকে নিটওয়্যারকে। এ পর্যন্ত কোনো টাকা পরিশোধ না করায় প্রথম ও দ্বিতীয় ডিমান্ড লোনের বর্তমান ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ১ লাখ ও ৩৫ কোটি ৮৫ লাখ। এছাড়া ২০২৩ সালে মঞ্জুরীকৃত ডিমান্ড লোনের বর্তমান স্থিতি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি ৭১ লাখ এবং ২০২৪ সালে মঞ্জুরীকৃত ডিমান্ড লোনে ঋণস্থিতি ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এসব ডিমান্ড লোন থেকে গ্রীন রোড শাখা কোনো টাকাই আদায় করেনি বা করতে পারেনি।
এর বাইরেও ডিকে নিটওয়্যারের টার্ম লোন ৫৫ কোটি ৪৫ লাখ, পিসি লোন ৮ কোটি ৮০ লাখ, ওএপি ৯ কোটি ৯২ লাখ রয়েছে। এছাড়া কোভিড-১৯ প্রণোদনা ১ কোটি ৯৫ লাখ, স্যালারি লোন ১৭ লাখ, আইএফবিসি (বিটিবি) লোন ২ কোটি ৮১ লাখ টাকাসহ প্রতিষ্ঠানটির মোট বৈদেশিক দায় দাঁড়িয়েছে ২৩৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা । এরমধ্যে ঋণ গ্রহীতা এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শুধুমাত্র টার্মলোন বাবদ ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা আদায় করেছে অগ্রণী ব্যাংক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা ডিকে'র ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাতেই এসব ঋণ প্রদান করা হয়েছে। তবে নামমাত্র মর্টগেজ থাকায় ঋণের শত শত কোটি টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এত কিছুর পরেও ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানটি আরও লোন নেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অগ্রণী ব্যাংকে দৌড়ঝাঁপ করছে বলেও জানান তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে ডিকে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়ীদ একিউএম জাহিদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদকের পরিচয় পেয়ে ফোন লাইন কেটে দেন। ঋণ জালিয়াতি ও টাকা লুটপাটের বিষয়ে গ্রীন রোড কর্পোরেট শাখার ব্যবস্থাপক মো. রোকনুজ্জামান এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মন্তব্যের জন্য হেড অফিসে যোগাযোগ করলে জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করতে বলা হয়। জনসংযোগ বিভাগের প্রধান ডিজিএম শাহনাজ চৌধুরী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বক্তব্যের জন্য কী কী বিষয়ে বক্তব্য চাওয়া হবে মর্মে একটি আবেদন দিতে বলেন এই প্রতিবেদককে। সে আবেদনের বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হলেও এবং কয়েকবার জনসংযোগ বিভাগে যোগাযোগ করেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মোহাম্মদ মাসুদ || বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ২১/১ নয়াপল্টন, ঢাকা-১০০০ || মোবাইল : ০১৫১১৯৬৩২৯৪,০১৬১১৯৬৩২৯৪ || ই- মেইল: dailysobujbangladesh@gmail.com || ওয়েব : www.dailysobujbangladesh.com
Copyright © 2025 দৈনিক সবুজ বাংলাদেশ. All rights reserved.