বই না কিনেও যে দোকানে বই পড়া যায়

সবুজ বাংলাদেশ ডেস্ক: 

রমজান আলীর বাবা ছিলেন দিনমজুর। টাকা দিতে না পারায় একবার তাঁর হাত থেকে ছেলের জন্য কেনা বই কেড়ে নিয়েছিলেন দোকানি। সেই রমজানই এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটে অন্য ব্যবসার পাশাপাশি বিনা মূল্যে বই পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। ওঙ্কার নামের এই বইয়ের দোকানে বই না কিনেও পড়া যায়। শুধু তা–ই নয়, নিয়মিত পড়লে মেলে পুরস্কার। আগামী ফেব্রুয়ারিতেই যেমন পুরস্কার পাবেন ১২ জন পাঠক।

ওঙ্কারের স্লোগান ‘বইয়ের সঙ্গে সন্ধি’। ওঙ্কার চত্বরে বসে কেউ যদি মাসে অন্তত ২০ দিন কমপক্ষে এক ঘণ্টা বই পড়েন, তাঁর জন্য থাকে উপহার—একটি সৃজনশীল ও একটি মননশীল বই। রমজান আলীর এমন আহ্বানে সাড়া দিয়ে সত্যিই শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এসে বসেন গাছের ছায়ায়। রাজশাহী বেড়াতে এসেও অনেকে ঘুরে যান। ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যেমন এসেছিলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। পরিদর্শন বইয়ে লিখেছেন, ‘ওঙ্কার নামটিই প্রবল শক্তির ডাক দেয়। এই বইয়ের সম্ভার প্রাণশক্তি দিক। অনেক শুভেচ্ছা।’ রমজান আলীর এই প্রাণশক্তির উৎস জানতেই গত ৪ নভেম্বর দুপুরে ওঙ্কার চত্বরে গিয়েছিলাম, নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক রহমান রাজু।

রমজান বলেন, ‘আব্বা দিনমজুর, কোনোমতে সংসার চলে, আমরা তিন ভাই। আমি সবার বড়। মনে আছে স্কুল থেকে এসে ইটভাটায় কাজ করেছি, কয়লা ভাঙার কাজ করেছি। এলাকার বুধপাড়া দাখিল মাদ্রাসায় ক্লাস সিক্সে ভর্তি করে দিলেন মা। এক বছর কোনোমতে পার হলেও ক্লাস সেভেনে ওঠার পর মূল সমস্যা শুরু—বইখাতা কেনার টাকা নেই। একদিন আব্বার সঙ্গে স্টেশনবাজারে বাংলা বই কিনতে গিয়েছি। বইয়ের দাম ১৭ টাকা। দোকানিকে ১০ টাকা দিয়ে আব্বা বলেছিলেন, বাকি টাকা পরে দেবেন। কিন্তু দোকানি শুনলেন না। আব্বার হাত থেকে বই কেড়ে নিলেন। আরেকবার খাতা–কলম না নিলে ক্লাসে স্যার মারবে, এই ভয়ে স্কুলে যাচ্ছি না। এদিকে মা মারছে, আমি কান্নাকাটি করছি—এই অবস্থা দেখে সেই ইটভাটার ম্যানেজার গোলাপ ভাই আমাকে দোকানে নিয়ে গিয়ে খাতা–কলম কিনে দিলে পরে স্কুলে গেলাম। এ রকম অনেক গল্প আছে।’

‘এলাকার এক ভাই একদিন বলল, শোন রঞ্জু, এভাবে পড়ালেখা হবে না। আমার সঙ্গে চল। ক্যাম্পাসে একটা দোকানে কাজে লাগিয়ে দিই। ১৪ বছর বয়সে ১৯৯৭ সালের জুন মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার হলের উল্টো দিকে স্টেডিয়াম মার্কেটে স্টুডিও লিবার্টিতে কাজ আরম্ভ করলাম। প্রায় সাত বছর কাজ করেছি। এরপর নিজে সেখানে একটি দোকান করলাম, ছবি বাঁধাইয়ের কাজ। ২০০৩ সালে আব্বা মারা গেলে সংসারের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়ল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের পেছনে পরিবহন মার্কেটে দোকান করে আসলাম ২০০৬–এর শেষের দিকে। শুরু করলাম উপহারসামগ্রীর সঙ্গে বই বিক্রি, যে বইগুলো একটু কম দামে পাওয়া যায়। এই মার্কেট ক্যাম্পাসের প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় অনেকের সঙ্গেই খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল।’

২০১০ সালের কথা, বাংলা বিভাগের তখনকার ছাত্র, বর্তমানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আবুল ফজলের সঙ্গে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক। একদিন দুজন মিলে চায়ের দোকানে গল্প করছি। একপর্যায়ে ফজল ভাইয়ের পরামর্শে সিদ্ধান্ত হলো দোকানে ভালো বই বিক্রি করব। লোহার বেঞ্চে বসে ফজল ভাই তখনই ১৭০ থেকে ১৯০টি দেশি-বিদেশি লেখকের বইয়ের নাম লিখে দিল। একসঙ্গে এত বইয়ের নাম দেখে অবাক হয়েছিলাম, এখন নিজেই ৫০০ বইয়ের নাম লিখতে পারি। ঢাকায় বাংলাবাজারে একদিন গেলাম, উত্তরণ প্রকাশনীর ম্যানেজার অরূপ দত্ত ও ছোট ভাই সুজন সিকদারের সঙ্গে পরিচয় হলো। এই দুজন পথপ্রদর্শক, আমার বইয়ের জোগানদাতা। দেখতে দেখতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা আড়াই যুগ হতে যাচ্ছে, একটা কুরিয়ার সার্ভিসের আমতলা এজেন্সি পরিচালনা করছি প্রায় ৯ বছর, তা থেকে সংসার চলে।

‘অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল সুন্দর একটি বইয়ের দোকান করব। সহজলভ্য ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, হলে হলে ওয়াই–ফাই ফ্রি—এসব কারণে ছেলেমেয়েরা বর্তমানে বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শুভাকাঙ্ক্ষী বড় ভাই, শিক্ষক, বন্ধু—যাঁদের সঙ্গে আমার নিত্য চলাচল, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করলাম। সবাই সাহস জোগাল। আহমদ ছফার উপন্যাস অবলম্বনে দোকানের নাম ঠিক করলাম  “ওঙ্কার”। স্বপ্ন দেখি, ক্যাম্পাস চত্বরে যেমন চা–সিগারেটের দোকানে একশ্রেণির শিক্ষার্থীরা সময় কাটান, এই ওঙ্কার চত্বরে শিক্ষার্থীরা বই নিয়ে আলোচনা করবেন, আড্ডা দেবেন। হবে সৃজনশীল আলোচনা, নিজেকে সুগঠিত করার আলোচনা। অনেক ছেলেমেয়ে আবার সেজেগুজে বইয়ের সঙ্গে ছবি তুলতে আসেন। আমি বলি আসুক, আসতে আসতেই বইয়ের সঙ্গে ওদের সন্ধি হবে।’

সেদিন রাত সাড়ে ৯টায় ওঙ্কারে গিয়ে ৭-৮ জন ছেলেমেয়েকে পাওয়া গেল, যাঁরা পড়ছেন। দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রাবেয়া মুহিব বললেন, যদি জিজ্ঞাসা করেন, ক্যাম্পাসে আমার সব থেকে পছন্দের জায়গা কোনটি, এককথায় বলব, ওঙ্কার চত্বর। সিলেবাসের বাইরে সাহিত্য, দর্শন, কবিতা, ইতিহাস পড়তে ভালো লাগে, আবার এদিকে লাইব্রেরিতে আপডেট বই পাওয়া যায় না। রাজশাহীতে ভালো মানের বইয়ের দোকান হাতে গোনা। না কিনে যদি বই পড়া যায়, মন্দ তো হয় না। এর মধ্যে রঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তিনি শিক্ষার্থীদের না কিনে বই পড়ার শুধু অনুমতিই দিলেন না, ঘোষণা দিলেন বই পড়লে পুরস্কার দেবেন। প্রতিদিন আমার মতো অনেক শিক্ষার্থী এখানে বই নিয়ে তর্ক করে, আড্ডা দেয়, কবিতা পড়ে আর ভালোবাসতে শেখে। ওঙ্কারের এই বই পড়া হয়ে উঠেছে আমার অর্ধেক ক্যাম্পাস। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু হুরায়রা বলেন, ‘ওঙ্কার–এ অনেক নতুন বইয়ের সংগ্রহ আছে, আর এখানে এত এত দামি বই আছে, যেগুলো অন্য কোনো দোকানে গেলে কিনতে অনেক টাকা লাগবে। সেই বইগুলো আমি এখানে খুব সহজেই শেলফ থেকে নামিয়ে পড়ে ফেলতে পারি। এই উচ্চমূল্যের বাজারে মাস পার করতেই যেখানে কষ্ট হয়ে যায়, সেখানে সাধারণ একজন ছাত্র হিসেবে নতুন নতুন বই কেনা কতটা কঠিন, যাঁরা বই কেনেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন। আমি ২০২৩ সাল থেকে নিয়মিত আসি।’

 

সবা:স:জু- ৫৫৬/২৪

বাবা, তোমারে ছাড়া জেলের মধ্যে আমি কেমনে থাকমু একলা একলা?

স্টাফ রিপোর্টার:

কোলেপিঠে আদর যত্নে তিল তিল করে গড়ে তোলা ২৫ বছর বয়সের বুকের ধন ছেলে কাউসার বাগমারকে বাবা হয়ে নিজ হাতে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করবেন, এমন চিন্তা কখনো করেননি বাবা রশিদ বাগমার। বাস্তবে এমন ঘটনাটি ঘটেছে আজ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার জামালপুর গ্রামে।

লেখাপড়া শেষে দেশে কোন চাকরি-বাকরি না পেয়ে সৌদি পাড়ি জমায় কাউসার বাগমার। চাকরির মেয়াদ শেষে বছর খানেক আগে দেশে ফিরে আাসে কাউসার। দেশে এসে শুরু হয় বেকার জীবন যাপন। এক পর্যায়ে মাদকসেবীদের পাল্লায় পড়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে কাউসার। বেকার জীবনে মাদকের টাকা জোগাড় করতে না পেরে মা-বাবার শরণাপন্ন হয় কাউসার। মাদক সেবনের কাংখিত পরিমাণ টাকা চেয়ে না পেয়ে মা-বাবার সাথে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি করতো কাউসার। মা বাবার নেশার টাকা জোগাড় করতে অবশিষ্ট আর কিছুই ছিলোনা তাদের হাতে।

মাদকের টাকার জন্য বাড়িতে ভাঙচুর ও বাবা-মাকে অত্যাচার ও নির্যাতন করা শুরু করে দেয় কাউসার। মাদকের টাকার জন্য বাবার নামে থাকা দুই কাঠা জমি বিক্রি করে নেশার জন্য টাকা দিতে বলে ছেলে কাউসার বাগমার। নিহতের বড় ভাই আশরাফুল বলেন, কাউসার সারা রাত নেশার ঘোরে বাড়ির বাইরে থাকতো ও মাদক সেবন করতো। কোন ভাবেই মাদক থেকে ফেরানো যাচ্ছিল না তাকে। মাদকের জন্য সব সময় মা বাবার কাছ টাকা চাইত। টাকা না দিলে বাড়িতে ভাঙচুর ও মা বাবাকে গালিগালাজ করতো। কাউসারের এমন পরিস্থিতিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। জমি বিক্রি করে নেশার টাকা না দিলে বাবা মাকে হত্যার হুমকি দেয় ছেলে।

এমন পরিস্থিতিতে বাবা রশিদ বাগমার সারা রাত কান্না করেন ছেলের মরণ ছোবল নেশার আসক্তের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে। ভোর রাতে বাবার পাশের রুমে গভীর ঘুমে ছেলে কাউসার। হঠাৎই বাবা রশিদ বাগমার বাড়িতে থাকা কুড়াল নিয়ে ছেলের রুমে ঢুকে কোপাতে শুরু করেন আদরের ধন ছেলে কাউসারকে। বাবার এমন কোপানোতে ছেলে বলতে থাকে, বাবা তুমি আমারে আর মাইরো না, আর কোপ দিওনা, আমি আর নেশার টাকা চাইমু না তোমগো কাছে!

ছেলের আর্তনাদের এমন চিৎকারে ছেলের উপর বাবার কুড়াল দিয়ে কোপানো থেমে যায় মুহূর্তে। রক্তাক্ত ছেলেকে আপন করে কোলে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কান্না করতে থাকেন বাবা নামের মানুষটি। কাঁদতে থাকেন আর বলতে থাকেন, বাবা তুই আমার আদরের ধন, কলিজার মানিক। ততক্ষণে ছেলের নিথর দেহটি বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে চিরদিনের জন্য।

আশপাশ থেকে ছুটে আসা মানুষজন ছেলে হত্যাকারী বাবাকে বলতে থাকেন, আপনি পালিয়ে যান, পুলিশ আসবে আপনাকে ধরে নিয়ে যাবে, আপনার ফাঁসি হবে, কারোর কথাই শুনছেনা বাবা, বাবা বলছেন, আমার বাবাডারে আমি অনেক ভালোবাসি, আমার বাবাডারে ছাইড়া আমি কই যামু? আমার আর বাইচা থাইকা লাভ নাই! ছেলের লাশের কাছে বসে বাবার এমন কান্নায় আশপাশের মানুষজনের চোখের পানি ছলছল করছে। মহিলারা আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন বারবার।

এমন সময় পুলিশ হাজির,, ছেলের মৃত্যু শোকে বাবা হাউমাউ করে বলতে লাগলেন আমি আমার পোলারে মাইরা ফালাইছি নেশার টাকা জোগাড় কইড়া দিতে না পারায়, আমারে জেল দেন ফাঁসি দেন, আমারে থানায় লইয়া যান! ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা কুড়ালটি জব্দ করে পুলিশ। স্ব-ইচ্ছায় পুলিশের সাথে রওনা দেয়ার সময় বাবা ছেলের শরীর জড়িয়ে ধরে আবারও হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বলতে লাগলেন, বাবা তোমারে আমি মারতে চাই নাই ! বাবা তোমারে আমি কথা দিয়া গেলাম, সরকারের আদালতে গিয়া আমি কমু, আমার বাবাডার হত্যাকান্ডের বিনিময়ে হলেও যেন দেশে মাদকের নেশার রাজ্য যেন বন্ধ করে সরকার!

আর দেশের সব বাবাগো কইয়া যাইতাছি, তোমরা মাদকের নেশা কইরো না, মাদকের নেশায় তোমগো মা বাবারা খুব কষ্ট পায়, সংসারের সব কিছু তছনছ হইয়া যায়! বাবা আমার খুব কষ্ট লাগতাছে, বাবা আমার বুকটা ছিড়া যাইতাছে তোমার লেইগা, বাবা তোমারে কই পামু আমি, তোমারে ছাড়া আমি জেলের মধ্যে কেমনে থাকমু একলা একলা? পুলিশের গাড়িতে উঠতে উঠতে বাবার এমনসব সাড়া জাগানো হৃদয় বিদারক কথা আর দুইচোখ ভরা বাবার কান্নায় উপস্থিত সবাইকে কাঁদিয়েছে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ, এলাকাবাসী ও স্বজনরা সরকারের কাছে বাবা রশিদ বাগমারের নি:শর্ত মুক্তি দাবি করেছেন।

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম