
স্টাফ রিপোর্টার।।
শহর থেকে গ্রামে অনলাইন জুয়া ছড়িয়েছে মহামারির মতো। জুয়ার ফাঁদে পা দিয়ে অনেকে হারাচ্ছে অর্থ। নিঃস্ব হয়ে বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা। আসক্ত হচ্ছে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। অনলাইনে গেমিং, বেটিং ও বাজি খেলার সাইটে ঢুকে নির্দিষ্ট সময়ে মিলছে বোনাস। লোভে পড়ে জুয়াড়িরা ক্রেডিট কার্ড, বিকাশের মাধ্যমে করছে অর্থ লেনদেন। বর্তমান সময়ে খেলার বিষয়টি পুরো সহজ হয়ে পড়েছে ব্যবহারকারীদের কাছে। অনলাইনে আন্তর্জাতিক এই বেটিং সাইটগুলোর মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে বড় অঙ্কের অর্থ। সূত্র জানায়, স্মার্টফোন এবং অনলাইনের সহজলভ্যতায় গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়া। জুয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এ অবস্থায় অনলাইন জুয়া রোধে গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছে সিআইডি।
জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে এ খেলায় উদ্বুদ্ধ করতে নানান চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। ভয়ঙ্কর এই জুয়ায় লাখ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। জুয়া খেলে এরই মধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের ফেসবুক গ্রুপে এ ধরনের জুয়ার লিংক অপলোড দেয়া হয়। মোবাইল ও ইন্টারনেটে ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা বাজি ধরা হয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে এই খেলা থেকেই এক সময় নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে তরুণরা। একটা সময় গিয়ে বড় ধরনের জুয়াড়িতে পরিণত হয়। এতে টাকার সংকটে সৃষ্টি হয় পারিবারিক কলহ। এটি একদিকে যেমন পারিবারিক ও সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়, অন্যদিকে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না।
কুমিল্লা জেলার কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে সিআইডি সাইবার টিম। সেখান থেকে বেটউইনার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দু’জন বাংলাদেশি এজেন্টসহ নগদের এক কর্মচারীকে আটক করা হয়। বেটউইনার মূলত অ্যাপসভিত্তিক একটি অনলাইন বেটিং সাইট। রাশিয়া থেকে এটি পরিচালিত হয়। স্পোর্টস, বেটিং এবং ক্যাসিনো সাইটের জন্য এটি বিখ্যাত। বংলাদেশে জুয়াড়িদের অন্যতম জনপ্রিয় ওয়েবসাইট এটি। সাইটটি বাংলাদেশে এজেন্ট নিয়োগ করে মোবাইল ফাইনান্সিয়্যাল সার্ভিস ব্যবহার করে অনলাইন এজেন্টদের সঙ্গে জুয়ার টাকা লেনদেন করে। পরবর্তীতে এসব টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (বাইন্যান্স মাধ্যম) রূপান্তর করে রাশিয়ায় পাচার করে। সিআইডি জানায়, গত বছরের ২রা আগস্ট ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান নিজের ফেসবুক পেজে ঘোষণা দেন নিউজ বেটউইনার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ তাকে নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক, সমালোচনা। গ্রেপ্তারকৃত এজেন্টদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সাকিব আল হাসান ব্র্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে যোগ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জুয়াড়িদের সংখ্যা দশগুণ বেড়ে যায়। তাদের মাধ্যমে অন্তত ৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
সিআইডি জানায়, বাজি ধরার নামে অনলাইন জুয়া সারা দেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এটা আর স্থানীয় পর্যায়ে বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আন্তর্জাতিক বেটিং সাইটগুলোয় বাংলাদেশি জুয়াড়িদের অংশগ্রহণ বেড়েই চলেছে। ফলে অনেকে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। একইসঙ্গে দেশের টাকার একটি অংশও চলে যাচ্ছে বিদেশে। দেশের অল্পশিক্ষিত থেকে শুরু করে অর্ধশিক্ষিত পর্যন্ত মানুষ খেলছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, এই অনলাইন জুয়া দমনে মাঠপর্যায়ে গবেষণায় নেমেছে সিআইডি। এই গবেষণার মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত এবং যারা এই ফাঁদে পা দিচ্ছে বা আসক্ত হচ্ছে তাদেরকেও সচেতন করা যাবে এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে।
সম্প্রতি তিনপাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে প্রেরণের মূলহোতা উল্কা গেমস লিমিটেডের সিইও জামিলুর রশিদসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। চক্রটি দেশে থেকে ২৯ কোটি টাকা পাচার করেছে পার্শ্ববর্তী দেশে। র্যাব জানায়, গেমস ডেভেলপমেন্টের ভুয়া চুক্তির কথা বলে বৈধ উপায়ে অর্থ পার্শ্ববর্তী দেশের কোম্পানির মুনফ্রগ ল্যাবের কাছে পাঠিয়েছে। বর্তমানে উল্কা গেমসের ৪টি অ্যাকাউন্টে প্রায় ৮০ কোটির অধিক টাকা রয়েছে। চক্রটির বেতন প্রদানসহ অফিস পরিচালনায় মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হতো। রাজধানীর মহাখালী ও উত্তরা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা জানায়, ২০১৯ সালে মুনফ্রগের ০.০১ শতাংশ উল্কা গেমসকে প্রদানের মাধ্যমে দেশে গেমিং খাতে উন্নয়নের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রদানের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হয়। দেশে গেম ডেভেলপমেন্টের অনুমোদন থাকলেও অনলাইন জুয়া বা ক্যাসিনোর অনুমোদন না থাকায় উল্কা গেমস বিভিন্ন ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আইনি বৈধতা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে। এভাবেই তিন পাত্তি গোল্ড যাত্রা শুরু করে শহর ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। উল্কা গেমসের যাত্রা গেমিং ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও তারা গেম ডেভেলপমেন্ট না করে তিন পাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে প্রেরণের কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। র্যাব জানায়, এই অ্যাপে তিন পাত্তি গোল্ড ছাড়াও রাখি, আন্দর বাহার ও পোকার নামেও অনলাইন জুয়ার গেমস রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, এই ধরনের অনলাইন জুয়া বা গেমসে আসক্তরা সহজে বের হয়ে আসতে পারে না। গেমসের মাধ্যমে যদি সৃষ্টিশীল অথবা বুদ্ধিভিত্তিক যে গেমসগুলো রয়েছে সেগুলো হতো তাহলে আপত্তি ছিল না। কিন্তু এই গেমসগুলো বুদ্ধিভিত্তিক যে প্রখরতা কিংবা বুদ্ধিভিত্তিক যে মাত্রা সেটি বাড়াচ্ছেই না বরং মানুষের শৃষ্টিশীল ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। পড়াশোনা থেকে তরুণদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এতে একটা বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এটি রাষ্ট্রের জন্য শুভকর কিছু নয়। প্রযুক্তিগত দিক থেকে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। পাশাপাশি যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত আছে তাদেরকে খুঁজে বের করা এবং কার কাছে টাকাটা পাঠানো হয় সেটিও কিন্তু কোনো না কোনোভাবে খুঁজে বের করা সম্ভব। তাহলে এই প্রবণতার সঙ্গে যারা জড়িত তারা ভয় পাবে বা আসক্তরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) বলেন, শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
যারা অ্যাপস ডেভেলপ করে তারা বিদেশ থেকে এই অ্যাপসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাংলাদেশে তারা নিজস্ব এজেন্ট ঠিক করে। এ সকল এজেন্টের মাধ্যমে ক্লাইন্ট কালেক্ট করে। আগে এই খেলায় ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে লেনদেন হতো এখন সেটি মুঠোফোনে বিকাশ, নগদ ও রকেটের মাধ্যমে সহজে পেমেন্ট করতে পারছে গ্রাহকরা। বর্তমানে শিক্ষিত থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নশ্রেণির মানুষ যুক্ত হচ্ছে এটি আমাদের জন্য একটি বড় দুঃসংবাদ। এই জুয়া খেলতে গিয়ে মনে হবে যে আমি জিতে যাচ্ছি কিন্তু দিন শেষে, মাস শেষে কেউই জিতে না। দেখা যাচ্ছে মাসে এক এক জনের ১০-১২ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে। যারা এই খেলায় অংশ নেয় তাদের বেশির ভাগের বয়স ১৮-২৫ বছরের মধ্যে। এজেন্টদের বয়স প্রায় দেখা গেছে ৩০-৪০ বছর। তিনি বলেন, জুয়ার এই ফাঁদে বিদেশে কোটি কোটি টাকা চলে যাওয়ায় আমাদের দেশকে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। এই কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব কাজে এমএফএস ব্যবহৃত না হয় তার ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিটিআরসিকেও এসব সাইট বন্ধ করতে কিংবা অনলাইন গেটওয়েতে ফিল্টারিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সবচেয়ে বড়কথা অনলাইন বেটিং-এর বিরুদ্ধে পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।