দীর্ঘ সাহসী অভিযাত্রায় বিএনপির ৪৭ বছর

মোহাম্মদ মাসুদ॥

দেশের ইতিহাসে আত্মত্যাগ, প্রতিরোধ এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর এক দীর্ঘ সাহসী অভিযাত্রা। এই অভিযাত্রার প্রতিটি বাঁকে বাংলাদেশি জাতি যখনই অস্তিত্বের প্রশ্নে হুমকির মুখে পড়েছে, গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হয়েছে কিংবা মানুষ নিঃশ্বাস ফেলার স্বাধীনতাটুকুও হারিয়েছে; তখন বারবার একটি নাম সামনে এসেছে- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী অগ্রযাত্রায় বারবার অগ্রণী ভূমিকা রাখা বিএনপির আজ ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্কিী। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গড়া দলটি আজ গৌরব ও আত্মত্যাগে সমুজ্জ্বল এক নাম।

১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তখনকার আওয়ামী লীগের সরকার দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল। এরপর অনেক রক্তক্ষয়ী ঘটনার সাক্ষী হয়েছে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশ। এক অরাজক ও অনিশ্চিত ভবিতব্য যখন চোখ রাঙাচ্ছিল, তখন সিপাহী-জনতার বিপ্লব সামনে নিয়ে আসে এক মহানায়ককে, যিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন ত্রাণকর্তা হয়ে।

বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনার বটমূল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

দেশকে সমৃদ্ধ ও মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে নেয়া নানা কর্মসূচির কারণে দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিএনপি। জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল সমৃদ্ধ দেশ গঠনে যুগান্তকারী সনদ।

দেশ যখন উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য হত্যা করে জয়িাউর রহমানকে। আবার এক মহাশূন্যতায় যখন দেশ, তখন রাজনীতিতে আগমন ঘটে তার সহধর্মিণী খালেদা জিয়ার। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিএনপি ফিরে পায় নতুন দিশা। রাজপথে তার আপোষহীন নেতৃত্ব স্বৈরাচার এরশাদের পতন ত্বরান্বিত করে।

শহীদ জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আর খালেদা জিয়ার দূরদর্শী বিভিন্ন কর্মসূচি তাকে দেশবাসীর কাছে দ্রুতই জনপ্রিয় করে তোলে। তার আপোষহীন নেতৃত্বে ৯ বছর পর জনগণের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সাল রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব পায় বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরপর আরও দুই দফা তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

পরবর্তীতে কর্তৃত্বপরায়ণ আওয়ামী লিগ সরকারের আমলে দুর্নীতির কথিত মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে ২০১৮ সালে কারাগারে নেয়া হলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে হাল ধরেন তারেক রহমান। দলকে সুসংগঠিত করা, আন্দোলনে গতি আনা এবং রাজনীতিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করাসহ নুতন নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে তিনি এগিয়ে নিচ্ছেন দলকে।

দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এক বাণীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘জনগণের অধিকার আদায়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাসহ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা আবারও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য।’

তারেক রহমান বলেন, ‘জাতীয়তাবাদী আদর্শের সাথে জনগণকে একত্রিত করার লক্ষ্যে মহান স্বাধীনতার ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। দিনটি বাংলাদেশি মানুষদের জন্য আনন্দ, উদ্দীপনা ও প্রেরণার। দলটি বাংলাদেশি ভূখণ্ডের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং শক্তিশালী সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দেয়ার নীতিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’

প্রায় ৫ দশকের পথচলা বিএনপির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে, গত ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক নয়া সমীকরণ। তাই গতানুগতিক রাজনীতি থেকে এবার বেরিয়ে আসতে চাইছে দলটি। সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ৩১ দফা সংস্কার রূপরেখা ঘোষণা করেছেন তারেক রহমান।

দলের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ ও পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাসসকে বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক শূন্যতা অনুভব করেই বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি শুধু বহুমত গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করেননি, বরং বাংলাদেশকে মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে গেছে। ‘

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। আজ আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, যেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষ আজ বিএনপির দিকেই তাকিয়ে আছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এর কারণ হল- বিএনপিই একমাত্র দল যারা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম। তাই আজকে আমরা শপথ নিয়েছি যে কোনো বাধাই আসুক, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠাতা করা ও মুক্ত বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করে যাবো। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে গণতন্ত্রকামী সব দলকে সঙ্গে নিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবো।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আজ দলের ৪৭ বছরে এসে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক ছিলেন। গণমানুষের দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন।’

বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিএনপির আন্দোলন অব্যাহত আছে উল্লেখ করে ড. মোশাররফ আরও বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও সংগ্রামের চূড়ান্ত অর্জন হলো চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। এই বিপ্লবের চেতনায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে আগামীতে দেশ পুনর্গঠনে সকলে একসঙ্গে কাজ করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যে দলটির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর, সেই দলটিই আজ আবার গণতন্ত্রের নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে এগিয়ে যাবে নতুন প্রজন্মের জন্য আগামীর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে। অদূর ভবিষ্যতে এটি হবে এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে থাকবে না ক্ষমতার দম্ভ অথবা আস্ফালন। এ মহান আদর্শে বিশ্বাসী হয়েই বিএনপি জনগণের জন্য রাজনীতি করে যাবে।

বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, ‘আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে বিএনপি অতীতের ভুলভ্রান্তি দূর করে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী দিনে বিএনপিকে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হতে হবে। বিগত দিনে দেওয়া ৩১ দফা রূপরেখা যে কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। দেশ পরিচালনায় তাদের অঙ্গীকারগুলো নতুন আঙ্গিকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রজ্ঞা প্রদর্শনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায়, ভবিষ্যতে ফের চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে দলটি।

বিএনপির আগামী দিনের পথচলা কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘দিন বদলেছে, বদলেছে প্রেক্ষাপটও। তাই বিএনপি বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তাদের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা ক্ষমতায় গেলে কতটুকু বাস্তবায়ন করবে সেদিকে তাকিয়ে আছে জনগণ।

তবে রাজনীতির এই বিশ্লেষক মনে করেন, জনআস্থা পেতে হলে বিএনপিকে দলে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা বুঝে কাজ করতে হবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করে পথ চলতে হবে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি:

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ৭ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। গতকাল ৩১ আগস্ট রাজধানীর রমনাস্থ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আজ ১ সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় বিএনপির নয়াপল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।

সকাল ১১টায় মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা ও আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তম-এর সমাধিতে বিএনপি মহাসচিবসহ দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। কাল দেশব্যাপী জেলা ও মহানগরে আলোচনা সভা ও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।

২ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হবে। ৩ সেপ্টেম্বর উপজেলা ও পৌরসভায় আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সমসাময়িক প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক হবে। সুবিধাজনক সময়ে ঢাকাসহ দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৃক্ষরোপণ অভিযান, মৎস্য অবমুক্তকরণ, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প ও ক্রীড়ানুষ্ঠানের কর্মসূচি রয়েছে দলটির।

প্রধানমন্ত্রী পদ ও সরকারের মেয়াদ নিয়ে বিএনপির আপত্তি

রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এই উদ্যোগের মাঝপথে এসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে।

বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী পদে একই ব্যক্তির দুই বারের বেশি না আসা, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের পদে একইসঙ্গে না থাকা, সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে চার বছরে কমিয়ে আনার মতো প্রধান কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে বিএনপি।

গত রোববার (২৩ মার্চ) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দেয়া প্রতিবেদনে এই বিষয়গুলোয় আপত্তির কথা জানায় দলটি।

মূলত বিএনপির ওই প্রস্তাব ঘিরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাজনীতির মাঠে এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা দেখা যায় বলে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

বিএনপির যুক্তি হলো, একটানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে কোনো এক ব্যক্তির না থাকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে তিনি দুই মেয়াদের পর বাকি জীবনে আর কখনো এই পদে আসতে পারবেন না–– এরকম বিধান করা ঠিক হবে না।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করে প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ না থাকার কারণে টানা চার মেয়াদ ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতায় থেকে তিনি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে নানা প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন, অন্যদিকে নিজের ক্ষমতাকেই পাকাপোক্ত করেছেন।

যে কারণে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদের বিষয়টি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে যে কেউ ক্ষমতায় গিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘কোনো সময়সীমা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদের শাসন আটকানো না গেলে একদিকে যেমন স্বৈরাচারী সিস্টেম বদল করা যাবে না, অন্যদিকে রাজনীতিতে নেতৃত্বের বিকাশও ঘটবে না।’

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো এইসব প্রস্তাব চূড়ান্ত করে বলে জানানো হয়।এখন বিএনপির আপত্তির কারণে এক ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা ও চার বছর মেয়াদের সরকারের মতো বিষয়গুলো সংস্কারে আটকে যেতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘এটা আমাদের দলগত সিদ্ধান্ত। তবে আমরা সব সময় উইন্ডো ওপেন রেখেছি যে আমরা আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে যৌক্তিকভাবে যে কোনো কিছুই আমরা মেনে নেবো।’

এই সংস্কারের পেছনে যুক্তি কী?
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংস্কারে উদ্যোগ এর আগেও নেওয়া হয়েছিল ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।

তবে পরের বছর ডিসেম্বরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পরই আদালতের রায়ের মাধ্যমে বাতিল করা হয় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।

এরপর দলীয় সরকারের অধীনে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। প্রতিবারই ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ, আর প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা সরকারে থাকা অবস্থায় প্রায় তিন দশকে বাংলাদেশে একের পর এক বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করা হয়।

গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নানা পরামর্শও নেয়।

পরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিটে ছক আকারে দিয়ে দলগুলোর মতামত চেয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি কখনো প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না।

বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী পদের কোনো সুনির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। সেই সঙ্গে একটানা কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে সে বিষয়টিও বেঁধে দেয়া নাই বাংলাদেশের সংবিধানে।

ফলে শেখ হাসিনা টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তাকে স্বৈরাচার তকমা নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয় পদ থেকে।

বিএনপি গত রোববার সংস্কার কমিশনের কাছে যে প্রস্তাব করেছে সেখানে তারা নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী পদ ও সরকারের মেয়াদ নিয়ে বিএনপির আপত্তি কেন?

তবে বিএনপি একটানা দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকার বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছে ঐকমত্য সংস্কার কমিশনের কাছে।

কেন সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদে বেঁধে দিতে চাইছেন তার একটি যুক্তিও বিবিসি বাংলাকে তুলে ধরেন সংস্কার কমিশনের সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম।

‘নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো কিংবা ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্র ফেরানোর জন্যই অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের পরামর্শে দুই মেয়াদ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি যুক্ত করেছে সংস্কার কমিশন।’

দুই মেয়াদে বিএনপির আপত্তি কেন?
ঐকমত্য কমিশনের কাছে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ সৃজনসহ ৬২টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।

ওই সুপারিশ জমা দেয়ার পর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারা চান যে টানা তিন মেয়াদ কেউ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। তবে এক মেয়াদ বাদ দিয়ে আবারও প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়া যাবে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদের ক্ষেত্রেও দুই মেয়াদ সময় বেঁধে দেয়া আছে। শুধু প্রধানমন্ত্রী পদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ বলা বলা নাই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রস্তাবনা পরপর দুই বার যদি কেউ প্রধানমন্ত্রী হন তাহলে তাকে একবার গ্যাপ (বিরতি) দিতে হবে। তারপর আবার প্রধানমন্ত্রী হতে বাধা নেই।’

‘এটাকে অনেকে মনে করতে পারে আমরা লাইফ টাইমে দুইবারের কথা বলেছি। বিষয়টা তেমন না। তার মানে পরপর তিনবার কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না,’ যোগ করেন তিনি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন কোনো দলের মধ্যে যদি অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র চর্চা বজায় থাকে অন্যদিকে শতভাগ নিরপেক্ষ ভোটে যদি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তাহলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে সংস্কার কমিশন বিবেচনা করতে পারে।

নির্বাচন ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুনিরা খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘টানা দুই মেয়াদে একটা প্রধানমন্ত্রী থাকা উচিত না। কিন্তু পরবর্তীকালে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে যদি কোনো নেতার দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের মধ্যে যদি সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা থাকে এবং তিনি যদি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জয়লাভ করেন, তার পদে বসার অধিকার থাকা উচিত।’

যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পদে এক ব্যক্তি দুই বারের বেশি থাকতে পারেন না।

একই সঙ্গে কেউ প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না বলে সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, সে বিষয়েও ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। এটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয় বলে মত তাদের।

সরকারের মেয়াদকাল নিয়েও আপত্তি
এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ বন্ধ ছাড়া সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ প্রস্তুত করেছে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করারও প্রস্তাব করেছে।

বিএনপি ঐকমত্য কমিশনে যে প্রস্তাব জমা দিয়েছে, তাতে তারা সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ নিয়ে দলের পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করারও বিরোধিতা করেছে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের যে প্রস্তাব সেই প্রক্রিয়াতেও সায় নেই দলটির।

কিন্তু বিএনপি কেন সরকারের চার বছর মেয়াদ নিয়ে আপত্তি তুলেছে সেই প্রশ্নও ছিল দলটির নেতাদের কাছে।

জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশে যে পাঁচ বছর মেয়াদের বিষয়টি আছে সেটাই স্ট্যান্ডার্ড, আমরা ওভার নাইট পরিবর্তন করে ফেলতে পারবো না।’

কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সরকারের মেয়াদ যদি এক বছর কমানো হয় তাতে দেখা যাবে যে অনেক সরকারই সফলতার সঙ্গে প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও সরকার পরিচালনা করতে পারবে না। কারণ এমন অনেক পরিকল্পনা রয়েছে যেটা বাস্তবায়নের জন্য চার বছর যথেষ্ট সময় পাবে না।

তবে সংস্কার কমিশনের যুক্তি, পাঁচ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। কখনো যদি কোনো সরকার ব্যর্থতার প্রমাণ দেয় তখন সেই সরকারের মেয়াদ শেষ কিংবা তার পতনের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে অপেক্ষা করতে হয়।

ড. আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘চার বছর যথেষ্ট সময়। সে যদি চায় চার বছরে অনেক কিছু করতে পারে। তাতে অন্য দল বিরক্ত হয় না। সব কিছু বিবেচনায় থেকে আমরা এই ধরনের প্রস্তাব করেছি।’

আর বিশ্লেষক মুনিরা খান বলেন, ‘পাঁচ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। কোনো দল একটানা পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে স্বৈরাচারের বীজও বপনের সুযোগ থাকে।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম