ভ্যাট ফাঁকির ৪৮ কোটি টাকা পরিশোধ করছেনা সিঙ্গার

স্টাফ রিপোর্টার॥
দেশে ভ্যাট ফাঁকির ঘঠনা যেনে নিয়মে পরিনত হয়েছ, যে যেভাবে পারে তা ফাকি দিয়েই যাচ্ছে আর এসবগুলো করছে বড় বড় কোম্পানীগুলো।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের পৃথক তদন্তে ওই ফাঁকির তথ্য উঠে এসেছে। তদন্তে পাওয়া তথ্যে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে সিঙ্গার বাংলাদেশের বকেয়া বা ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের পরিমাণ ২৭ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ টাকা। আর ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভ্যাট বাবদ ২০ কোটি ৬৪ লাখ ৩২ হাজার ৮০৯ টাকা ফাঁকি দিয়েছে।

টাকা আদায়ে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নিতে গত ১ নভেম্বর এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। যেখানে ফাঁকি দেওয়া বা বকেয়া টাকা পরিশোধে সিঙ্গার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অসহযোগীতার বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে ভ্যাট গোয়েন্দা ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিষ্ঠানটির আয়, গৃহীত অতিরিক্ত রেয়াত, উৎসে মূসক ও স্থান এবং স্থাপনা ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট যথাসময়ে পরিশোধ না করায় সেগুলো আদায় করতে আইনগত ব্যবস্থা নিতে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছি। আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির মূসক ফাঁকির তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। সবচেয়ে অবাক লেগেছে অবৈধ রেয়াত সুবিধা নেওয়ার জন্য একীভূত (মার্জ) হওয়া প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের নামে ভ্যাট রিটার্ন জমা দিয়েছে সিঙ্গার। অবৈধ রেয়াত নেওয়ার জন্যই এই রিটার্ন জমা দেওয়া হয়। এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট থেকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হলেও কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পাত্তা দিচ্ছে না।

সিঙ্গার বাংলাদেশের মূসক ফাঁকি সম্পর্কিত গোপন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, দেখা গেছে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড একীভূত হওয়া প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের নামে অবৈধভাবে রেয়াত গ্রহণ, প্রতিষ্ঠানটির ১৯টি ওয়্যারহাউস ও ৩২৪টি বিক্রয়কেন্দ্রের মূসক বা ভ্যাটের নিবন্ধন না থাকা এবং ওয়্যারহাউস ও বিক্রয় কেন্দ্র থেকে পণ্য বিক্রির বিপরীতে মূসক জমা দেয়নি। তদন্তে এসব বিষয়ে সত্যতা পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে সিঙ্গার বাংলাদেশের কোম্পানি সচিব কাজী আনিসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এমনকি খুদে বার্তা দেওয়া হলেও তার জবাব মেলেনি।

তবে সিঙ্গার বাংলাদেশের কমিউনিকেশ ইনচার্জ নাজমুস সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি পরে জানাবো।

সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী যেমন- টিভি, ফ্রিজ, এসি, গ্রাইন্ডার, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে থাকে। তবে কিছু পণ্য বিদেশ থেকে সরাসরি আমদানি করে থাকে।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেডের তিনটি ইউনিট তিন মূসক কমিশনারেটের আওতায় নিবন্ধিত। ইউনিটগুলো হলো- সিঙ্গার বাংলাদেশের দিলকুশা বাণিজ্যিক ইউনিট, সাভারের রাজফুলবাড়ীয়া ও হেমায়েতপুর ইউনিট। এর মধ্যে সিঙ্গার বাংলাদেশের দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার ইউনিট ঢাকা দক্ষিণের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, সাভারের হেমায়েতপুরের কুলাসুর ইউনিট ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেট এবং সাভারের রাজফুলবাড়ীয়ার জামুল ইউনিট বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (ভ্যাট) আওতাভুক্ত। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর তদন্ত শুরু করে। এরপর শুরু হয় তদন্ত কার্যক্রম।

তদন্তে যা পাওয়া গেল
সিঙ্গার বাংলাদেশের ওই তিন ইউনিটের দাখিলপত্র যাচাই-বাছাই করে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মূসক বা ভ্যাট বাবদ ১৪ কোটি ২৮ লাখ ৪৯ হাজার ৮০০ টাকা ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছে ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। যার মধ্যে আয় খাতে ফাঁকি দেওয়া মূসক বা ভ্যাটের পরিমাণ হচ্ছে ১ কোটি ৯৬ হাজার ৬১৮ টাকা, অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণের মাধ্যমে ২ লাখ ২১ হাজার ১০৮ টাকা ও উৎসে ভ্যাট কর্তনের মাধ্যমে ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৪ টাকা ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যেখানে প্রযোজ্য সুদের পরিমাণ ১৩ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার ৪৬৩ টাকা। সব মিলিয়ে ২৭ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার ২৬৪ টাকা আদায়যোগ্য বলে ভ্যাট গোয়েন্দার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

প্রতিষ্ঠানটির মূসক ফাঁকি সম্পর্কিত গোপন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপ্লায়েন্স লিমিটেডের নামে রেয়াত গ্রহণ, প্রতিষ্ঠানটির ১৯টি ওয়্যারহাউস ও ৩২৪টি বিক্রয়কেন্দ্রের মূসক বা ভ্যাটের নিবন্ধন না থাকা, ওয়্যারহাউস ও বিক্রয় কেন্দ্র থেকে পণ্য বিক্রির বিপরীতে মূসক জমা না দেওয়ার বিষয়েও সত্যতা পাওয়া গেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মূসক, গৃহীত অতিরিক্ত রেয়াত, উৎসে মূসক ও স্থান এবং স্থাপনা ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য মূসক বাবদ সুদসহ সরকারি পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৫৯ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ টাকা। এই বকেয়া আদায়ে পরবর্তী আইনগত কার্যক্রমের জন্য এনবিআরে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

২০১৯-২০২১ সালের মেয়াদে আরও ফাঁকি ২০ কোটি
ভ্যাট নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের পৃথক তদন্তে আরও দেখা যায়, সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানটির ওই তিনটি ইউনিট থেকে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদের নিরীক্ষায় পরিহার করা মূসক, গৃহীত অতিরিক্ত রেয়াত, উৎসে মূসক ও স্থান এবং স্থাপনা ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য মূসক বা ভ্যাট বাবদ ২০ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার টাকা ফাঁকি দিয়েছে। যা সরকারি কোষাগারে যথাসময়ে জমা হওয়ার কথা ছিল। তা না করে প্রতিষ্ঠানটি বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। প্রযোজ্য ভ্যাটের সঙ্গে ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনের ১২৭ নং ধারায় মাসিক ২ শতাংশ সুদে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ লাখ ৮০ হাজার ৮০৬ টাকা।

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অতিরিক্ত রেয়াত গ্রহণের মাধ্যমে ১৫ কোটি ৯২ লাখ ৭ হাজার ৪১৪ টাকার ভ্যাট ও উৎসের মূসক কর্তনবাবদ ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮৯ টাকা ফাঁকি দিয়েছে। এভাবে মোট ২০ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। ২ শতাংশ সুদে ৩২ লাখ ৮০ হাজার ৮০৬ টাকার সুদ প্রযোজ্য রয়েছে। সব মিলিয়ে ২০ কোটি ৬৪ লাখ ৩২ হাজার ৮০৯ টাকার ভ্যাট আদায়যোগ্য বলে ভ্যাট গোয়েন্দার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে এনবিআর বরাবর পাঠানো চিঠিতে আরও কিছু বিষয়ের গুরুত্ব দিয়ে সুপারিশ করেছে। যার মধ্যে রয়েছে- সিঙ্গার বাংলাদেশের সব ইউনিটের নাম একই হওয়ায় পৃথক পৃথক কমিশনারেটে দাখিলপত্র দাখিল করায় রেয়াত যাচাই ও সার্বিক মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন। ফলে একই কমিশনারেটের অধীনে কেন্দ্রীয় নিবন্ধন থাকা বাঞ্চনীয় বলে মনে করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ব্যাপক হওয়ার পরও মূসক বা ভ্যাট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সফটওয়্যার না থাকার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। সে কারণে দ্রুততার সঙ্গে সফটওয়্যার গ্রহণের জন্য প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট মূসক কমিশনারেটকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

লন্ডনে নজরুল ইসলামের বিলাসবহুল দুই বাড়ি

সবুজ বাংলাদেশ ডেক্স॥
লন্ডন শহরের ব্যয়বহুল একটি এলাকা কেনসিংটন। এখানকার ফিলিমোর গার্ডেন এবং ব্রান্সউইক গার্ডেনে বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি ও তার মেয়ের মালিকানাধীন কোম্পানির নামে বিলাসবহুল দুটি বাড়ির হদিস মিলেছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে এই দুটি বাড়ি কিনতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। তখনকার হিসাবে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ছিল ২৩১ কোটি টাকা—পাউন্ডের বর্তমান দর অনুযায়ী যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা। কোনো রকম মর্টগেজ সুবিধা ছাড়াই নগদ টাকায় এ মূল্য পরিশোধ করেছেন তারা। ব্রিটিশ সরকারের ল্যান্ড রেজিস্ট্রি দপ্তর ও ব্রিটিশ কোম্পানি হাউসের নথিপত্রে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

এই শিল্পপতির নাম নজরুল ইসলাম মজুমদার। দেশে তার পরিচিতি বিশাল। তিনি বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী নাসা গ্রুপের কর্ণধার। বেসরকারি বাণিজ্যিক এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ধনকুবের এই বাবার মেয়ে আনিকা ইসলাম স্থায়ীভাবে লন্ডনেই বসবাস করছেন।

তথ্যমতে, ফিলিমোর গার্ডেনে ‘এএনডব্লিউ লন্ডন প্রোপার্টিজ লিমিটেড’ কোম্পানির নামে মালিকানাধীন বাড়িটি কেনা হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। নিবন্ধিন নথিতে যার পরিচিতি নম্বর রয়েছে—বিজিএল ৩৭৩৬৬। বাড়ির পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা: ৩০ ফিলিমোর গার্ডেনস, কেনসিংটন, লন্ডন ডব্লিউ৮ ৭কিউ ই। ৫০০ বর্গমিটারের (৫৩০০ বর্গফুট) এ বাড়িটি কেনা হয় ৯৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে। যেখানে ৫টি বেডরুম, ৪টি বাথরুম ও ৪টি রিসিপশন রুম রয়েছে।

ব্রান্সউইক গার্ডেনে ‘নাসা প্রোপার্টিজ লিমিটেড’ কোম্পানি নামে মালিকানাধীন অন্য বাড়িটি কেনা হয় ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ সালে। যার পরিচিতি নম্বর হলো—এনজিএল ৪৭৫৭৩৭। পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা হলো: ২ ব্রান্সউইক গার্ডেন, লন্ডন ডব্লিউ৮ ৪এজে। ৩৯৬ স্কয়ার মিটারের বাড়িটির ক্রয়মূল্য ছিল ৮ মিলিয়ন পাউন্ড। এতে ৫টি বেডরুম, ৪টি বাথরুম, ৩টি রিসিপশন রুম ও সুসজ্জিত গার্ডেন রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালে যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচারসহ দেশের আর্থিক খাতে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম সংঘটিত করার অভিযোগ উঠেছিল শিল্পপতি নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে তার পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও আমদানি-রপ্তানিতে জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নাসা গ্রুপ ও এর অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নজরুল ইসলাম মজুমদার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

এতে আরও বলা হয়, শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে যে পরিমাণ আমদানি করা হয়েছে, রপ্তানি হয়েছে তার চেয়ে অনেক কম। এভাবে গত চার বছরে কমপক্ষে ২১০ কোটি টাকা যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশে তিনি পাচার করে থাকতে পারেন। যদিও শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য কারণে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, অধিক প্রভাবশালী ও সরকার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ওই সময় উত্থাপিত অভিযোগটি অধিকতর তদন্ত না করেই অনেকটা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে, যা আজও আলোর মুখ দেখেনি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাস বলেন, এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য তার জানা নেই।

বাংলাদেশ ও লন্ডনের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ধারণা, বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে পাচার করা টাকার একাংশ দিয়েই মূলত লন্ডনের কেনসিংটন শহরের বিলাসবহুল বাড়ি দুটি নগদ মূল্যে কেনা হয়। ওই সময় দুটি কোম্পানিরই পরিচালক পদে ছিলেন নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার মেয়ে আনিকা ইসলাম।

ব্রিটেনের আবাসন খাতের পরামর্শক কোম্পানি অ্যাসটনসের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, লন্ডনে দামি সম্পত্তি কেনার দৌড়ে ভিনদেশি ক্রেতাদের শীর্ষ ১০ তালিকার নবম স্থানে আছেন বাংলাদেশিরা। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশিরা ৯৮টি সম্পত্তি কিনেছেন, যার মোট ক্রয়মূল্য ১২ কোটি ২২ লাখ ৯০ হাজার পাউন্ড।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ওই প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশের পরই সতর্ক অবস্থান নেন নজরুল ইসলাম মজুমদার। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারিতে লন্ডনের ‘এএনডব্লিউ লন্ডন প্রোপার্টিজ লিমিটেড’ এবং ‘নাসা প্রোপার্টিজ লিমিটেড’ কোম্পানি দুটি থেকে নজরুল ইসলাম মজুমদার তার পরিচালক পদ প্রত্যাহার করে নেন। বর্তমানে তার মেয়ে আনিকা ইসলাম এককভাবে কোম্পানি দুটির পরিচালক।

এদিকে ব্রিটিশ সরকারের ল্যান্ড রেজিস্ট্রি দপ্তর ও ব্রিটিশ কোম্পানি হাউস থেকে পাওয়া নথিপত্রে দেখা যায়, ‘এএনডব্লিউ লন্ডন প্রোপার্টিজ লিমিটেড (১১৭৪৮২৩২)’ কোম্পানিটি ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি ব্রিটিশ কোম্পানি হাউসে নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধনকালে আনিকা ইসলাম ছিলেন কোম্পানিটির একক পরিচালক। পরে একই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি ‘নাইটিংগেল করপোরেট সেক্রেটারিস ইউকে লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানিকে সেক্রেটারি পদে এবং ৮ ফেব্রুয়ারি নজরুল ইসলাম মজুমদারকে পরিচালক পদে সংযুক্ত করা হয়। কেনসিংটনের পিলিমোর গার্ডেনের ‘এএনডব্লিউ লন্ডন প্রোপার্টিজ লিমিটেড’ কোম্পানির নামে কেনা বিলাসবহুল বাড়িটির জন্য কোনো ধরনের মর্টগেজ বা ঋণ ছাড়া নগদ ৯৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড এককালীন পরিশোধ করা হয়।

একইভাবে ব্রান্সউইক গার্ডেনের ‘নাসা প্রোপার্টিজ লিমিটেড (১২১১৪৬২৮)’ নামের কোম্পানি ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ব্রিটিশ কোম্পানি হাউসে নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধনকালে নজরুল ইসলাম মজুমদার ছাড়াও ওয়ালিদ ইবনে ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তি কোম্পানিটির পরিচালক ছিলেন। ২০২০ সালের ২১ জুলাই ওয়ালিদ ইবনে ইসলাম কোম্পানি থেকে অব্যাহতি নেন। একই দিন নজরুল ইসলাম মজুমদারের মেয়ে আনিকা ইসলাম পরিচালক নিযুক্ত হন। একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর বাড়ির মূল্য বাবদ ৮০ লাখ পাউন্ড এককালীন পরিশোধ করা হয়।

লন্ডনে বাড়ি কেনার বিষয়ে জানতে চাইলে নাসা গ্রুপ ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার  বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে লন্ডনে আমার নামে কোনো বাড়ি নেই। ওখানকার নাসা গ্রুপের নামে যে বাড়ি রয়েছে, তার সঙ্গে এখানকার নাসা গ্রুপের কোনো সম্পর্ক নেই। দুটির মালিকানা সম্পূর্ণ ভিন্ন। লন্ডনের নাসা গ্রুপটি চালায় আমার মেয়ে। সে লন্ডনের স্থায়ী বাসিন্দা। সেখানেই সে ব্যবসা করে। মেয়ে প্রথমে আমাকে না জানিয়ে তার কোম্পানির পরিচালক হিসেবে আমার নাম রেখেছিল। বিষয়টি জানার পর আমি নিজেই তা প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এখন আর আমি ওই কোম্পানিতে নেই। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার কোনো আর্থিক সম্পর্কও নেই।’

অর্থ পাচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ অবাস্তব কথা। আমি একটি ব্যাংকের পরিচালক এবং চেয়ারম্যান। সেইসঙ্গে দেশের ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবিরও চেয়ারম্যান। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি হাউস আমাদের। ফলে আমাদের টাকা পাচার করতে হলে এভাবে পাচার করতে হবে নাকি? প্রতি মাসে আমাদের বিদেশ থেকে ১৫-২০ মিলিয়ন ডলারের মালপত্র আসে। যদি আমাদের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে তো আমরা সেই মালের মাধ্যমেই পাঠাতে পারি।’

২০২০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের কাছ থেকে বার্ষিক ঋণ সীমার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে নাসা গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রক্রিয়ায় একটি শীর্ষ পর্যায়ের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে পরপর চার বছর নাসা গ্রুপের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ইউনিট ঋণের সীমা অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ, বছরে যে পরিমাণ ঋণ নেওয়ার সীমা নির্ধারিত রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি তার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে।

প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫ সালে টেক্সটাইল ইউনিট ১৪৫ কোটি টাকা ঋণ সীমার বিপরীতে ঋণ নিয়েছে ৩৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, সীমার অতিরিক্ত ঋণ নেয় প্রায় ২০৯ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৬ সালে ২৯ কোটি ও ২০১৭ সালে প্রায় ১৩ কোটি টাকা সীমার অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে। অন্যদিকে গার্মেন্টস ইউনিট ২০১৭ সালে সীমার অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে ১১৯ কোটি ও ২০১৮ সালে সীমার অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে ৫৬ কোটি টাকা।

অন্যদিকে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে আমদানির সুযোগ পায়। সাধারণত রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান হলে আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি হয়; কিন্তু চার বছরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নাসা গ্রুপের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস ইউনিটের আমদানির চেয়ে রপ্তানি কম হয়েছে। ২০১৫ সালে টেক্সটাইল ইউনিট আমদানির চেয়ে রপ্তানি কম করেছে ২১২ কোটি টাকা। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে তা যথাক্রমে ৪৭ কোটি ও ৩৬ কোটি টাকা। একইভাবে গার্মেন্টস ইউনিট ২০১৫ ও ২০১৭ সালের আমদানির চেয়ে রপ্তানি কম করেছে যথাক্রমে ৯৪ কোটি ও ১১ কোটি টাকার।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক  জানান, ওই সময় পরিদর্শন প্রতিবেদনে যে ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ধরে নয়, বরং সার্বিকভাবে আমদানি-রপ্তানিতে যে ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়; তার ফাঁকফোকর বন্ধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে সার্বিকভাবেই আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন এই অনিয়মের প্রবণতা কমে এসেছে।

তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিষয়টিকে দেখছেন ভিন্নভাবে। বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। এটিও হয়তো তারই অংশ। পরিদর্শন প্রতিবেদনে বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শুধু তাই নয়, বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরও বিএফআইইউ এবং দুদক নির্বিকার থেকেছে।

তিনি বলেন, পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানে বিভিন্ন ধাপে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত, দেশ থেকে অর্থ পাচার করা হয়েছে; দ্বিতীয়ত, পাচার করা অর্থ দিয়ে মেয়ের নামে লন্ডনে বিলাসবহুল বাড়ি কেনা হয়েছে। যদিও সেখানে মেয়ের আয়ের উৎস উল্লেখ করা হয়নি। তার মানে, এই অর্থ দেশ থেকেই পাচার করে সেখানে নেওয়া হয়েছে। আইন অনুযায়ী, সেই দেশের সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা উচিত।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারের রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থাকলে অর্থ পাচারের এসব ঘটনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যেত। নজরুল ইসলাম মজুমদারের মেয়ের আয়ের উৎস সম্পর্কে সরকার চাইলেই খোঁজ নিতে পারত; কিন্তু সরকার তো সেটা করবে না। কারণ, তিনি একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং সেইসঙ্গে ব্যাংক মালিকদের সংগঠনেরও চেয়ারম্যান। সরকার উল্টো একের পর এক তাদের দাবি মিটিয়ে যাচ্ছে। ৯ বছরের জায়গায় ১২ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকা, ব্যাংকের বাইরে সহযোগী প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান থাকার সুযোগও দিয়েছে সরকার।
সূত্রঃ কালবেলা॥

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম