সংবাদ ক্ষেত্রে সংস্কার কতদূর

” শওকত মাহমুদ”
রাষ্ট্র সংস্কারের প্রণোদনা এবং আলোচনা এখন সর্বত্র। হাজার প্রাণের বিনিময়ে সফল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের লক্ষ্যও ছিল তাই। সরকার প্রথমে ছয়টি এবং পরে চারটি কমিশন গঠন করেছে। মিডিয়াসংক্রান্ত কমিশনটি হয়েছে সিনিয়র সাংবাদিক কামাল আহমেদের নেতৃত্বে। তাকে অভিনন্দন জানাই। তথ্য পরিচালকরা বলছেন, লোক নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। আশা করি শিগগিরই হয়ে যাবে এই কমিশন। কেননা, রাষ্ট্র সংস্কারের অবশ্য-অঙ্গ হতে হবে মিডিয়ার। হাসিনার দুঃশাসন সংবাদপত্র জগৎকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। হাতেগোনা দলকানা কয়েকটি সংবাদ প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিককে ধনী বানানোর বিনিময়ে ব্যাপক সাংবাদিক সমাজকে আর্থিকভাবে পঙ্গু, মানসিকভাবে পর্যুদস্ত এবং সত্য বলার অধিকার থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। অনেকেই আছেন সম্ভাব্য সংস্কারকে তাচ্ছিল্যভরে দেখছেন। প্রতিবিপ্লবের আশায় আছেন। ভাবখানা হচ্ছে ওসব করে কী হবে? দরকার নেই। ওই যে এক মরমি কবি বলেছেন, ‘মাটির জনম না ছিল যখন তখনও করেছি চাব, দিন রজনী না ছিল যখন তখনও গনেছি মাস।’ আমরা অমন নকলি নবাবের জাতি। প্রথমেই বলে রাখি, এই কমিশনের নাম হওয়া উচিত ‘বাংলাদেশ প্রেস কমিশন’। ‘মিডিয়া কমিশন’ নয়। প্রেস শব্দটার ব্যাপ্তি বেশি এবং এটা মুদ্রিত, বৈদ্যুতিন বা ইলেকট্রনিক এবং অন্য যে কোনো তথ্যমাধ্যমকে অন্তর্ভুক্ত করে। সংবিধান প্রণেতারা ‘প্রেস’ এবং বাংলা করেছেন ‘সংবাদ ক্ষেত্র’। মিডিয়া শব্দটির চল বেশি দিনের নয়, টিভি-রেডিওর সাংবাদিকতা থেকে উৎসারিত। সংবিধান ও আইনের সংস্কার হাসিনা সরকারের বিতর্কিত পঞ্চম সংশোধনী প্রথমবারের মতো সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর খড়গ এনেছে, তা লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। ৭ ক অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায় এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। কোন ব্যক্তি উপর্যুক্ত কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে তাহার এই রূপ কার্যও অপরাধ হইবে।’ বুঝলাম, ক্যু ঠেকাতে এই অনুচ্ছেদ। এটা সংবিধান সংস্কার কমিশন বুঝবে কী হবে এর পরিণতি। এখন তো সংসদ ভাঙার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে না। এর আইনি বিহিত কি হবে? ইমার্জেন্সি দিয়ে ২০০৭ এর ২২ জানুয়ারি নির্বাচন আটকে দেওয়া হয়েছিল। এবার কী হবে? এই মাথাব্যথা বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালকদের। কিন্তু আমার চিন্তা হলো ‘মতপ্রকাশ’কে যদি ‘ষড়যন্ত্র’ গণ্য হয় এবং এই সংবিধানের যে কোনো বিধানের প্রতি আস্থা পরাহত করার চেষ্টা বা মতপ্রকাশকে যদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিবেচনা করা হয়, তাহলে আমি যাব কোথায়? সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ বা দফা সম্পর্কে সমালোচনা করার অধিকার নাগরিকরা হারিয়ে ফেলেছে। অতএব এর সংশোধন জরুরি। দ্বিতীয়ত ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।” এই অনুচ্ছেদটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের কিংবা বিশ্বের আধুনিক রাষ্ট্রসমূহের এমনকি সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ বা ইউরোপীয় কনভেনশনের কোন দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু গোলমালটা হচ্ছে, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কবিষয়ক শর্তের ক্ষেত্রে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত রাজনীতিবিদ মরহুম আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে প্রথম প্রেস কমিশন হয়েছিল। শীর্ষ সম্পাদকরা ছিলেন এর সদস্য। এই কমিশনের রিপোর্ট বলছে, “বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার শর্তটি ভারত বাদে বিশ্বের আর কোন সংবিধানে পাওয়া যায় না। ভারতের সংবিধানে এটা ঢুকেছে ১৯৫১ সালের প্রথম সংবিধান সংশোধন আইনে। … এই শর্তটির ক্ষেত্রে অনেকেই আপত্তি দিয়েছেন এই বলে যে, সংবাদপত্রের দায়িত্ব হচ্ছে বৈদেশিক সম্পর্ককে পর্যালোচনা করা। এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যে, পত্রিকার রিপোর্টের জন্য কোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। কমিশন মনে করে, ‘We are also of the viwe that the press should be free to express opinion and analyse development on relations with foreign states. There can be no deûing the fact that such discussion serve a useful purpose by presenting points of viwe which otherwise would not have been known. It should also be appreciated that foreign policy and relations with foreign states are not static and healthy discussion in the press would rather he helpful in effecting the desired changes.’ প্রেস কমিশনের এই সুপারিশ কেউ কানে তোলেনি। বরং ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সাইবার অপরাধ আইনে এ সংক্রান্ত ধারা জুড়ে দিয়ে সাংবাদিকদের সন্ত্রস্ত করেছে। দুর্জনের মতে, ভারত বিরোধিতা রুখতে এই বিধান। বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত বাক, ব্যক্তি, চিন্তা, বিবেক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে সামান্যই আইন আছে, কিন্তু নিষেধাজ্ঞামূলক বা সাবধানী আইন বেশি। অবসরপ্রাপ্ত বিচারক জনাব মতিন বলেছেন, ওই নিশ্চয়তা দানমূলক দফা দিয়ে যুক্তিসংগত বাধার দফাগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায়। এর ক্ষমতার তুলনা তিনি করেছিলেন হজরত মুসা (আ.)-এর জাদুকরী লাঠির সঙ্গে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের বিচার বিভাগ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে যুগান্তরী রায় দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। ‘আমার দেশ’-এর মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমান উচ্চ আদালত সম্পর্কে লেখালেখির জন্য জেল খেটেছেন। তিনি আদালতের কাছে ক্ষমা চাননি। এক বিচারপতি ওই শুনানির সময় এমন মন্তব্যও করেছেন যে, Truth is no defense (সত্য কোনো রক্ষাকবচ নয়)। অথচ ভারতীয় সংবিধানে ‘Press freedom’ শব্দ দুটি না থাকলেও উচ্চ আদালতগুলো নানা রায়ে মৌলিক ও মানবাধিকারের উল্লেখ করে মতপ্রকাশের অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আইন-সংস্কার বাংলাদেশে প্রচলিত নানা আইনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে নানা কিসিমের গিঁট্টু থাকে। সম্ভাব্য কমিশনকে অবশ্যই দেখতে হবে সাইবার অপরাধ আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৯৭৩ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, আদালত অবমাননা আইন, সচিবালয় নির্দেশিকা ইত্যাদি আইনগুলো। তথ্য অধিকার আইনে তথ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্র প্রসারিত করতে হবে। আচ্ছা, সংবাদপত্র বা টিভির লাইসেন্সিং প্রথা তুলে দেওয়া যায় না? এসবের নামে হয়রানি এবং অপমানজনক মুচলেকা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। কদিন আগে মিডিয়া সাপোর্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক সাংবাদিক জিমি আমির এক আলোচনা সভায় বলছিলেন, ‘সংবাদভিত্তিক প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে পরিশোধিত মূলধন আলাদা রেখে মূল কার্যক্রম পরিচালনা করা। অর্থাৎ যেসব মালিক ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন-ভাতার অঙ্গীকার করবেন শুধু তারাই প্রতিষ্ঠান চালুর অনুমতি পাবেন। বেতন-ভাতা অনিয়মিত হলে বা পরপর তিন মাস বা ছয় মাস না দিলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাও নির্ধারণ করে দেওয়া। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে পরিশোধিত মূলধন থেকে কর্মীদের পাওনা মেটাতে হবে। আরও বলি, সেন্সরশিপ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থার স্থায়ী অবসান প্রয়োজন। সাংবাদিকদের দেখতে হবে, জাতীয় প্রেস ক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ডিআরইউসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সমিতি যেন পেশার সম্মান বজায় রেখে চলতে পারে। সংস্কার এসবেও দরকার। সংবাদপত্রের মালিকানা ওয়েজবোর্ড বিটিভিকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বলা হতো সাহেব-বিবির বাক্স। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর এর স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি আর এগোয়নি। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আকাশ-সংস্কৃতি অর্থাৎ স্যাটেলাইট টিভির সূচনা ঘটে। এক হিসাবে বর্তমানে দেশে টিভি ৪৫টি, ২৮টি এফএম, ৩২টি কমিউনিটি রেডিও, ১০০টি অনলাইন পোর্টাল এবং প্রায় ১ হাজর ৩০০ পত্রিকা রয়েছে। শেখ হাসিনা অধিকাংশ গণমাধ্যমের লাইসেন্সদাতা এবং তিনি গর্ব করে বলতেন, এসবের লাইসেন্স তো আমিই দিয়েছি। এসবের অধিকাংশ মালিক সমাজের লুটেরা শ্রেণি এবং আওয়ামী লীগের নেতা বা সমর্থক। এক জরিপে দেখা যায়, ৩২টি ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এসবের মালিক। তারা নির্লজ্জভাবে সরকারকে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি জনগণকে সত্য জানতে দেয়নি। আর নিজস্ব ব্যবসায়িক ধান্দা ও প্রতিযোগীকে ঠেলাঠেলির জন্য গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন। ধনী পরিবারের বৈশিষ্ট্য যেমন নানা শিল্পের মালিক, তেমনি মিডিয়ার মালিকানাও তাদের হাউসে থাকতে হবে। শেয়ারবাজার বা ভূমিবাজারে দস্যুতা করে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে মিডিয়ায় সামান্য খয়রাতি করলেই তো চলে। অন্যদিকে কতিপয় সাংবাদিক নেতাকে স্বৈরাচারী সরকার টিভি, পত্রিকার লাইসেন্স এবং পুঁজি দিয়েছে। কালো টাকার অবাধ লগ্নি ঘটেছে মিডিয়ায়। সাংবাদিকরা তাদের জন্মদিন পালন করতেন অভিজাত হোটেলে। তারা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মিডিয়া উপকমিটির সদস্য ছিলেন। কমিশনের পক্ষ থেকে সংবাদপত্র শিল্পের পুঁজি মালিকদের মিডিয়া-মনস্কতা, সাংবাদিক-কর্মচারীদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি দেখা উচিত। সাংবাদিক-কর্মচারীদের ওয়েজবোর্ড নিয়ে কারও কারও আপত্তি আছে। কিন্তু ইতিহাস ও বাস্তবতা সাক্ষ্য দেয় সাংবাদিকরা মজুর। নতুন সমাজ বাস্তবতায় আমরা শ্রমিক পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করি। কিন্তু শ্রমিকের অধিকার আইনে সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত। তা ছাড়া টিভি ও পত্রিকার সাংবাদিকদের বেতনবৈষম্য দূর করাও জরুরি। সাংবাদিক সমাজ সাংবাদিকের সংখ্যা এখন প্রচুর। কিন্তু মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবে চরম রাজনীতিকরণের কারণে সামাজিক মর্যাদা আগের মতো নেই। সাংবাদিক হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো যাচাই প্রক্রিয়া নেই। তাই মিডিয়া লিটারেসির প্রশ্ন উঠেছে। আমাদের মিডিয়া সে কারণে ন্যাশনাল মিডিয়াও হয়ে উঠতে পারেনি। বড় বড় রাজনৈতিক দল মিডিয়াকে কবজা করতে ব্যস্ত। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে। তাই দলীয় কর্মীও ঢুকছে সাংবাদিক পরিচয়ে। ঢাকার দুটি সাংবাদিক ইউনিয়নে সদস্য সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। বিশ্বাস হয় ঢাকায় এত লোক সাংবাদিকতা করে? ফুটপাতের বা সেলুনের নাপিতও রয়েছে সদস্য হিসেবে। এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিদ্যা পড়া তরুণরা আসছে। আমাদের পূর্বসূরিরা যেমন গদ্য, পদ্য লেখালেখির মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতায় এসেছেন, সে ঐতিহ্য আর নেই। এসব বলার একটাই কারণ। যে গণঅভ্যুত্থান স্বপ্ন দেখিয়েছে নতুন বাংলাদেশের, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সংবাদপত্রকেও তার উপযোগী করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিল এবং প্রেস ইনস্টিটিউটকে আরও ক্ষমতাবান ও সক্রিয় হতে হবে। প্রেস কাউন্সিলের কার্যপরিধির মধ্যে সংবাদপত্রের জন্য আচরণবিধি তৈরি, সংবাদপত্রের জন্য উচ্চ আদর্শসম্পন্ন আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন, সাংবাদিকদের জন্য জনরুচির উচ্চমান রক্ষা করা, সাংবাদিকদের মধ্যে দায়িত্বশীলতা এবং জনসেবায় কাজ করার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি প্রমুখ। তারপর মানহানির বিচারও করতে পারে। তবে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান পদে আপিল বিভাগের বিচারক বসানোর বিধান পরিবর্তন করে একজন সিনিয়র সাংবাদিককে পদায়ন করা বাঞ্ছনীয়। তদুপরি জুডিশিয়াল কমিটির সদস্য হিসেবে চলমান সরকার সমর্থকদের নিয়োগ দিলে ন্যায়বিচারও নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। প্রেস ইনস্টিটিউটের উচিত, যারা সাংবাদিকতার আছে ও আসতে চান, এমনদের জন্য নিবিড় প্রশিক্ষণ এবং ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করা। সরকারি মালিকানাধীন সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনা। রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থার পুঁজি সরকারের হাতে কিছু রেখে বাকিটা সংবাদপত্র সম্পর্কিত মালিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া, যাতে সংস্থাটির সাংবাদিকতা ও জবাবদিহি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সবশেষে বলব, রাষ্ট্র পরিচালকরা যদি সহিষ্ণু, উদার গণতান্ত্রিক হন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হন, তবেই মিডিয়া সংস্কার সফল হবে। লেখক: সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেস ক্লাব

জঙ্গীদের নাশকতা : পুলিশের তাণ্ডব

সাঈদুর রহমান রিমন:

কয়েক বছর ধরে বিশেষায়িত বাহিনীগুলো দেশে জঙ্গী নেই, জঙ্গী নেই বলে ধোয়া তুলে সরকারকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার পর কী দেখতে পেলো দেশবাসী? দেখতে পেলো ৭২ ঘন্টাব্যাপী নজিরবিহীন তান্ডব। এ তান্ডব কোনভাবেই ছাত্রদের নয়। পুরোটাই ভয়ঙ্কর জঙ্গীদের নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ। সরকারকে দিশেহারা বানাতে, রাষ্ট্রকে পঙ্গু করে দিতে যা যা দরকার সেগুলোই তারা করেছে, পরিকল্পিতভাবে।

এবারের ভযাবহ নাশকতায় জামায়াত শিবিরের সম্পৃক্ততা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ দল দুটি সরকার বিরোধী যুৎসই আন্দোলন করার সক্ষমতা আরো আগেই হারিয়েছে। ২০১৩-১৪ সালের অসহযোগ আন্দোলনের পর গত একদশকেও তারা মেরুদণ্ড দাঁড় করে আর কোনো আন্দোলন জমিয়ে তুলতে পারেনি। বরং আন্দোলনের নামে আচমকা কিছু অরাজকতা ঘটিয়ে পরক্ষণেই লাপাত্তা হতে দেখা গেছে। বর্তমানে দল দুটির অবস্থা আরো করুণ। একটা ককটেল ফুটলেও আশপাশের কয়েক মহল্লার বিএনপি জামায়াত ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা ৭২ ঘণ্টা ধরে একের পর এক নাশকতা চালাবে- এমন সক্ষমতা অর্জন অবিশ্বাস্যই বটে।

নাশকতার ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে হামলাগুলোতে বিএনপি জামায়াত শিবিরের পরিচিত মুখের বর্ণনা শোনা যায়নি এখনও। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বরাবরই প্রধান রাস্তার নির্দ্দিষ্ট গন্ডিতে জমায়েত হয়ে দিনভর স্লোগানসহ নানাবিধ বার্তা প্রচার করতে দেখা গেছে। বিক্ষুব্ধ মিছিল নিয়ে তারা এদিক সেদিক প্রদক্ষিণ করেনি বললেই চলে।

তাহলে এরইমধ্যে কারা সংঘবদ্ধ মিছিল নিয়ে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালালো? মেট্রো রেলে কারা আগুন জ্বালালো? সেখানকার ভিডিও ফুটেজসমূহে প্রথম সারির হামলাকারীদের চেহারা অবশ্যই রয়েছে। গুলিতে হতাহত শিক্ষার্থীদের কারো চেহারার সঙ্গে কোনো মিল কি খুঁজে পাওয়া গেল?

এসব কারণেই সংঘটিত নাশকতাসমূহে জঙ্গীদের অংশ গ্রহণের বিষয়টি বারবার সামনে আসছে। একটু পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যায়, দলগুলো জ্বালাও পোড়াও ভাংচুর চালায় নিজ নিজ সংগঠনের শক্তিমত্তা দেখাতে। কিন্তু জঙ্গীরা যাবতীয় নাশকতা ঘটায় যুদ্ধ স্টাইলে, চমকে যাওয়ার মতো অভাবনীয়তায়। যেমন হঠাৎ করেই নরসিংদী কারাগার দখলের মাধ্যমে বন্দী থাকা জঙ্গীদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা। এতটাই চমকে দিলো তারা যা ঘটনার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কারো কল্পনাতেও ছিল না।

একইভাবে ছাত্র আন্দোলনের ‘সাইড স্টোরি’র মতো সিরিজ ঘটনাগুলোও ঘটেছে চমকানোর মতো নাশকতায়। নিরাপত্তা বেষ্টনীর মেট্রো রেলে হামলা, ভাংচুর ও জ্বালিয়ে দেয়া, একের পর এক অধিদপ্তর ভবনে আগুন লাগানো, ভবনগুলোর সুরক্ষিত পার্কিং লটে ঢুকে শত শত সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে কয়লায় পরিণত করা। কঠিন নিরাপত্তা বলয়কে তুচ্ছ করে বিটিআরসি ভবনের ১১ তলায় উঠে কেন্দ্রীয় সার্ভার স্টেশন ধ্বংসের প্ল্যানিং যোগ্যতাও নেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী কিংবা ন্যুব্জ থাকা দলগুলোর। এসব নাশকতা দেশকে পঙ্গু করাসহ সরকারকে চরম বেকায়দায় ফেলার জঘণ্য যুদ্ধ কৌশলই বটে।

নাশকতার সিরিজ ঘটনার মধ্যেই রয়েছে পুলিশের স্থাপনাগুলো গুড়িয়ে দেয়াসহ নরসিংদী কারাগার দখল করার ঘটনা। সেখানে বন্দী থাকা শীর্ষ ৯ জঙ্গী ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং বাকী ৮২৬ কারাবন্দীকে ছেড়েও দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রশিক্ষিত জানবাজ জঙ্গী ছাড়া এসব তান্ডব চালানোর দুঃসাহস কোনো দল বা গোষ্ঠীর আছে বলে মনে করি না।

বিভিন্ন মহলের মত অভিমত অনুযায়ী রাজধানী জুড়ে ভয়ঙ্কর তান্ডবলীলা চালানোর ঘটনাসমূহে কয়েকশ জঙ্গীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল বলে ধারণা করা হয়। অথচ জঙ্গী না থাকার ধোয়া তুলে কয়েক বছর ধরেই বিশেষায়িত বাহিনীগুলো ছিল নির্জিব ভূমিকায়।

যখন জানা গেল, কুকিচিন আর মিয়ানমারের গোপন আস্তানাগুলোতে ১০/১২টি ব্যাচে কয়েকশ’ জঙ্গী উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছে, দক্ষতা অর্জন করেছে ভারি অস্ত্রশস্ত্র চালানোতেও। তারাই তো ছড়িয়ে আছে দেশে। সেই প্রশিক্ষিত জঙ্গীদের অবস্থান, গতিবিধি, পরিকল্পনার কোনো কিছুই সরকার জানতে পারলো না। জঙ্গীদের ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ডাটা ব্যাংক খুব বেশি সবল নয়। এসব ব্যর্থতায় কোনো সংস্থার মধ্যে উদ্বেগ উৎকন্ঠাও নেই।

কারা বেশি লাভবান?

অপরাধ বিজ্ঞানের বহুল প্রচলিত সংজ্ঞা হচ্ছে, যে অপরাধ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যে বা যারা লাভবান হয় তারাই কোনো না কোনোভাবে সে অপরাধে সম্পৃক্ত থাকে- এটাই প্রাথমিক সূত্র হিসেবে পরিচিত। তাহলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে যা কিছু ঘটে গেল সেগুলো থেকে সবচেয়ে লাভবান হলো কে বা কারা?

একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, কোটা কেন্দ্রীক আন্দোলনের পূর্ব সময় পর্যন্ত দেশে দুর্নীতি-লুটপাট বিরোধী বিরতিহীন কলমযুদ্ধ চলছিল। সে যুদ্ধে ১৬ পুলিশ কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সেক্টরের অর্ধ শতাধিক কর্তার ভেদ কাহিনীও ফাঁস হয়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে শত কোটিপতি বনে যাওয়া হয়তো হাজার খানেক কর্তার মুখোশ উন্মোচন হতে পারতো।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে লুটপাটের তথ্য উদঘাটন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি ঘটেছে। এতে আলাদীন চেরাগের মালিক বনে যাওয়া শত শত কোটি টাকা আর বেশুমার সম্পদধারী লুটেরাগণ সবচেয়ে লাভবান হয়েছেন। এক্ষেত্রে জঙ্গীরা কতটুকু লাভবান হলেন সেটি অবশ্য অভিজ্ঞ মহলের বিশ্লেষণের ব্যাপার।

লুটেরা গোষ্ঠী আর উগ্রবাদী জঙ্গীদের মধ্যে একটি জায়গায় খুব মিল রয়েছে, তারা কেউ দেশের মঙ্গল চায় না বরং উভয় গোষ্ঠীই দেশ ধ্বংসের তৎপরতায় লিপ্ত। দেশের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা, মায়া, ভালোবাসা নাই- তারাই ভয়ংকর নাশকতা চালানোর নেপথ্য কারিগর। জঙ্গীদের ভয়ঙ্কর সিরিজ নাশকতার পেছনে লুটেরাদের অর্থায়ন থাকার অভিযোগ উঠলেও তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

মেট্রো রেল, বন ভবন, ত্রাণ ভবন, স্বাস্থ্য ভবন, বিটিআরসি ভবন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে যে অরাজকতা ঘটানো হয়েছে তা নজিরবিহীন। শত শত সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে কয়লা বানানো হয়েছে। এমন পৈশাচিকতা মেনে নেয়া যায় না। রাষ্ট্রকে পঙ্গু বানানোর এ কেমন ধ্বংসযজ্ঞ? এসব স্থাপনায় সিসিটিভি ফুটেজে হামলাকারীরা চিহ্নিত, তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক।

অভিযোগ উঠেছে, স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের সব দায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। চেষ্টা হয়েছে এই কারণে, যাতে তাদের উপর নিপীড়ন ও হত্যার মতো অতিমাত্রার ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায়। হেলিকপ্টার থেকে শিক্ষার্থী জমায়েতের স্থানসমূহে টিয়ার শেল ও মুহূর্মুহু গলিবর্ষণের ঘটনা অতিমাত্রায় ক্ষমতা ব্যবহারের কথাটি মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক (ডিজি), অতিরিক্ত আইজিপি মো. হারুন অর রশিদ বলেছেন, সহিংসতা ঠেকাতে র‌্যাব হেলিকপ্টার থেকে কোনো গুলি করেনি। এগুলো প্রপাগান্ডা।

অনুসন্ধানে অন্য কিছু

আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জঙ্গী বিষয়ক রিপোর্টিংয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা অগ্রজ সাংবাদিকদের মুখে শুনেছিলাম নানা চাঞ্চল্যকর কাহিনী। নানা পরিকল্পনা ও যুদ্ধ কৌশলে দক্ষ জঙ্গীরা ঘটনার কয়েক ধাপ পর্যন্ত নিজেরাই সম্পৃক্ত থাকে।

সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা উদাহরণ দিয়ে জানান, কোথায়ও জঙ্গীদের শক্তিশালী বোমা হামলায় হয়তো ১০ জন ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন, আহত হলেন অপর ৩০ জন। দ্বিতীয় ধাপে আহতদের নিয়ে হাসপাতালে দিকে রওনা দেয়া এ্যাম্বুলেন্সগুলোকে পথে আটকে আগুনে পুড়িয়ে দিবে আরেক গ্রুপ। বিভিন্ন পথে কিছু আহতকে নিয়ে হাসপাতালে হয়তো পৌঁছানো হলো। কিন্তু তাদের চিকিৎসা শুরু হতে না হতে তৃতীয় গ্রুপটি হাসপাতালেই বোমা হামলা চালিয়ে বাকিদের মৃত্যু নিশ্চিত করে ফেলবে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত বেশ কয়েকটি নাশকতার কথা সবাই জানি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আন্দোলন ছাড়ার ২৪ ঘণ্টা পর পুলিশের সোয়াত টিমের সদস্যরা যা ঘটিয়েছে তাতো জঙ্গীদের কয়েক ধাপের ভয়াবহতার বিষয়টি বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেখানে মাত্র দুই ঘন্টার ব্যবধানে ছয় জন পথচারী নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

বারিধারা বসুন্ধরা গেটে ২০ জুলাই কারফিউ ভঙ্গ করে সন্ধ্যা অবধি শিক্ষার্থী জমায়েত চলে। আন্দোলনের পরবর্তী কোনো কর্মসূচি না জানিয়েই শিক্ষার্থীরা রাত ৯ টার মধ্যে স্থানটি ছেড়ে চলে যায়। পরদিন ২১ জুলাই দুপুর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো তৎপরতা ছিল না। তবে দুপুর একটার পর ভাটারার দিক থেকে পুলিশ ভ্যানে থাকা সোয়াত টিমের সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালাতে চালাতে বসুন্ধরা গেট এলাকায় আসে। সেখানে গাড়ি থেকে নেমেও তারা দুই পাশের ফুটপাতে পথচারীদের দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে শতাধিক রাউন্ড গুলি চালায়। এতে ওভারব্রিজের অদূরেই ফুটপাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আনুমানিক ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই মারা যান।

এরপর পুলিশ দলটি বসুন্ধরা গেট থেকে কুটুর গলি পর্যন্ত ২০০ গজ দীর্ঘ রাস্তায় বাজার, দোকানপাট, ফুটপাত লক্ষ্য করে মুহুর্মুহু গুলি চালাতে থাকে। একপর্যায়ে অপ্রশস্ত কুটুর গলিতে ঢুকেও দুই পাশের ঘনঘিঞ্জি বাসা, বাড়ি, বস্তি সাদৃশ্য ঘরগুলোর দিকে আরো প্রায় ৫০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে পুলিশ দলটি আজিজ রোডের দিকে চলে যায়। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত আজিজ রোড, হারেজ রোড, মসজিদ রোড, জে ব্লকের অলিগলি এবং প্রগতি সরণির দুই কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে পুলিশের বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ ছিল নজিরবিহীন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জে ব্লকের গির্জা গেট থেকে যমুনার গেট পর্যন্ত প্রগতি সরণির দুই কিলোমিটার রাস্তা ও আশপাশের গলিতে অন্তত ৫০০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়েছে। টার্গেট ছিল রাস্তা ও ফুটপাতের পথচারী, সাধারণ মানুষ। সন্ধ্যার সময়ই আচমকা সোয়াত সদস্যরা আবারও গুলি চালাতে চালাতেই ঢুকে পড়ে ঘনবসতিপূর্ণ আজিজ রোডে। গলির মোড়েই গুলিতে মারা যায় মাছ ব্যবসায়ি আমজাদ (৪৫) নামে একজন। তার লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই ছোট ভাই ইনতাজুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বেলাল নামে এক শ্রমিক। এসময় গলির দুই’শ গজ ভিতরে মসজিদের সামনে পাশাপাশি চার জন পথচারী গুলিবিদ্ধ হন এবং ঘটনাস্থলেই তারা মারা যান। ভয়ানক আতঙ্কে গোটা এলাকার রাস্তা, গলি জনশূন্য হয়ে পড়ে।

চার লাশ ফেলা গাড়িটি ফেরার সময় এক সবজি বিক্রেতা জোড় হাত তুলে জানতে চান, স্যার লাশগুলো কি করবো? ভ্যানের সামনের আসনে থাকা এক কর্মকর্তা তাকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িতে লাশ ফেলে দিও। অবশ্য ঘন্টা দেড়েক পর আজিজ রোডস্থ সোসাইটির কর্মকর্তারা ভ্যানে তুলে লাশ চারটি নিয়ে যায় বলে খবর পাওয়া গেছে। কোনো লাশের ময়নাতদন্ত হয়নি। অভিন্ন স্টাইলেই লাশ পড়েছে গুলশানের শাহজাদপুরসহ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকাতেও।

নির্বিচারে সাধারণ পথচারী, দোকানপাট লক্ষ্য করে শত শত রাউন্ড গুলিবর্ষণ, একই এলাকায় দুই ঘণ্টার ব্যবধানে ছয় জন খেটে খাওয়া মানুষ হত্যা, লাশ না নিয়ে উন্মুক্ত প্রদর্শনীর মাধ্যমে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনীটির এ আচরণ কি কারফিউ ভঙ্গের শাস্তি, নাকি সর্ব সাধারণের মাঝে সরকার বিরোধী অসন্তোষ সৃষ্টি? নাকি জঙ্গীদের সিরিজ নাশকতা ঠেকাতে পাল্টা পুলিশি তান্ডব?

যদি বলা হয়, কারফিউ ভঙ্গের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর ভূমিকা নিয়েছে, তাহলে কারফিউ জারির প্রথম দিন (২০ জুলাই) পুলিশ কোথায় ছিল? সেদিন সকাল থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত প্রধান সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে কারফিউ ভঙ্গ করে প্রকাশ্য ছাত্র জমায়েত হয়েছে, কিন্তু পুলিশের কোনো সদস্য ভুলেও সেখানে যাননি কেন? কারফিউর মর্যাদা রক্ষায় কেন তারা ভূমিকা নেননি? পরদিন শত শত রাউন্ড গুলিবর্ষণকারীরা তো পুলিশই ছিল, নাকি অন্য কেউ?

(লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক)

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম