অনলাইন প্রতারণা, হুন্ডি ও জুয়ার মাধ্যমে ৩৪ কোটি টাকা পাচার

স্টাফ রিপোর্টার।।
সংঘব্ধভাবে অনলাইন প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অর্জিত ৩৪ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং অভিযোগে অভিযুক্ত সংশ্লিষ্ট ৯ জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৭/৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে সিআইডি।

সিআইডির প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, এই প্রতারক চক্রটি প্রথমে টেলিগ্রামে বিভিন্ন মানুষের কাছে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের প্রস্তাব দিতো। পরবর্তীতে কেউ সম্মত হলে তাকে এমন একটি টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত করা হতো যেখানে ওই টার্গেটকৃত ব্যক্তি ছাড়া বাকি সব আইডি ভুয়া। সেই গ্রুপে ভুয়া আইডির পজেটিভ রিভিও দেখে ভিকটিমরা ফ্রিল্যান্সিং কাজে সম্মত হলে তাদেরকে প্রথমে সাধারণ কিছু কাজ দেওয়া হতো এবং প্রথম বার ৮-১০ হাজার টাকা প্রদান করা হতো। এতে ভুক্তভোগীর আস্থা অর্জন করা হতো, যেন মনে হয় সব ঠিকঠাক চলছে। একবার আস্থা তৈরি হলে তারা বড় প্রজেক্টের প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতো।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন খান জানান, চক্রটি শুধু অনলাইন প্রতারণাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে দরিদ্র ও নিরক্ষর মানুষদের টার্গেট করত। তাদের সরকারি ভাতার প্রলোভন দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা হতো। এই পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ভুয়া ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (বিকাশ, নগদ) অ্যাকাউন্ট খোলা হতো। অনেক সময় মানুষ জানতও না যে তার নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এরপর এই অ্যাকাউন্টগুলো ব্যবহার করা হতো টেলিগ্রামে প্রতারণা, অনলাইন জুয়া ও হুন্ডির লেনদেনে। ভুক্তভোগীর জমা অর্থ ধীরে ধীরে চক্রের মূল সদস্যদের কাছে স্থানান্তরিত হতো।

চক্রটি দেশের অসাধু ব্যবসায়ী ও ঘুষ দুর্নীতির অর্থও হুন্ডি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাঠাত। অর্থ স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত জটিল। চক্রটি একাধিক ভুয়া এবং পরিবারের সদস্যদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ছোট ছোট লেনদেনের মাধ্যমে প্রকৃত উৎস লুকিয়ে রাখত। এতে বাইরের কেউ সহজে বুঝতে পারত না কতটা অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরিবারের সদস্য ও সহযোগিরা একে অপরের অ্যাকাউন্টে পরপর অর্থ পাঠাত, যাতে সবকিছু খুবই স্বাভাবিক দেখায়।

সবশেষে, চক্রটি অর্জিত অর্থ ডিজিটাল হুন্ডি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করত। তারা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ডলার বা ক্রিপ্টো ক্রয় করে তা বিদেশি ঠিকানায় স্থানান্তর করত। এক কথায় চক্রটি আস্থা তৈরি করা, বড় প্রজেক্টের প্রলোভন দেখানো, ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলা এবং ক্রিপ্টো বা হুন্ডি ব্যবহার; সব মিলিয়ে তারা মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।

প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেয়ে ভুক্তভোগীদের প্রদেয় তথ্য ও তার ব্যবহৃত এমএফএস/ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে চক্রটির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সত্যতা পাওয়ার পর ৯ জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৭/৮ জনের বিরুদ্ধে নারায়নগঞ্জ সদর থানায় মামলা হয়েছে। এজাহারনামীয় অভিযুক্তরা হলো ১. আরিফুল ইসলাম রিফাত (২৩), পিতা- মৃত আনোয়ার হোসেন, মাতা- লিলি, সাং- স্থায়ী বাঁশগাড়ি কান্দা পাড়া, থানা- বাঞ্চারামপুর, জেলা- ব্রাহ্মনবাড়িয়া, এ/পি- সারুলিয়া (ডগাইর পশ্চিম পাড়া), উপজেলা- ডেমরা, জেলা- ঢাকা। ২. মো. ইমরান হোসেন, (৩০), পিতা- মো. সিদ্দিকুর রহমান, মাতা- আজিতন নেছা, স্থায়ী ঠিকানা-ডিএম খালী, শরীয়তপুর সদর, শরীয়তপুর; এ/পি- ১০/১ রহমান ভিলা, মাজদাইর, পাক্কাপুল, ফতুল্লা, নারায়নগঞ্জ ৩. মো. নুরে আলম (৩৮), পিতা- মো.। সিদ্দিকুর রহমান, মাতা- আজিতুন নেছা, ঠিকানা- ৪৯/২ শহীদ সাব্বির আলম খন্দকার সড়ক, মাসদাইর, ফতুল্লা, নারায়নগঞ্জ। ৪. মোছা. লিলি আক্তার (৫৫), স্বামী- মৃত আনোয়ার হোসেন, পিতা- সামসুল হক, মাতা- মফিয়া খাতুন, ৫. মোছা. রিমি আক্তার (৩৪), পিতা- মৃত আনোয়ার হোসেন, মাতা- লিলি আক্তার, ৬. রুমি আক্তার (৩৬), পিতা- আনোয়ার হোসেন, মাতা- লিলি আক্তার, স্বামী- আব্দুল কাদির জিলানি (৩৯), সর্ব সাং- গ্রাম-বাঁশগাড়ি, বাঞ্চারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৭. আব্দুল কাদির জিলানি (৪০), পিতা- মো. আব্দুল আলিম, মাতা- খোদেজা বেগম, ঠিকানা- ডগাইর পশ্চিম পাড়া, হোল্ডিং নং-০৯, ওয়ার্ড-৬৬, ডগাইর, সারুলিয়া, ডেমরা, ঢাকা। ৮. মুহা. নেয়ামতুল্লাহ (৩০), পিতা- ছালামতুল্লাহ, মাতা- মোহছেনা বেগম, ঠিকানা- নয়ামটি, দেওলপাড়া, কুতুবপুর, থানা- নারায়নগঞ্জ সদর, নারায়নগঞ্জ এবং ৯. মোঃ রিয়াদ (২৫), পিতা- মিজানুর রহমান, মাতা- শিরিন বেগম, ঠিকানা- ৫৭ কেল্লাবন্দ চওড়াপাড়া, সি.ও বাজার,থানা- রংপুর সদর, রংপুর।

এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে প্রধান হোতাদের দায়িত্বে ছিলেন একই পরিবারের সদস্যরা। চক্রের মূল নায়ক আরিফুল ইসলাম রিফাত, তার মা লিলি আক্তার, দুই বোন রিমি আক্তার ও রুমি আক্তার, এবং বোনের স্বামী আবদুল কাদির জিলানী সরাসরি প্রতারণার পুরো কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন।

বর্তমানে ঘটনাটির তদন্ত কার্যক্রম ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট পরিচালনা করছে। অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটন, অপরাপর সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করার স্বার্থে সিআইডির তদন্ত ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার, অভিযোগ প্রমাণিত তবুও বহাল

আয়েশা আক্তারঃ

ঢাকা জেলা সাব-রেজিস্ট্রারদের প্রধান সাবিকুন নাহার চাকুরিজীবনে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদ অর্জন ও স্বেচ্ছাচারিতার জন্য ব্যাপক আলোচিত। সাবিকুন নাহারের অবৈধ সম্পদ,দুর্নীতি ও অনিয়মের খোজেঁ বেশ কিছুদিন ধরে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সাবিকুন নাহারের ধানমন্ডি ১০/এ রোডে ৩৭/এ গোলাপ ভিলা- ১ ও ২ নামে আট তলা দুইটি বাড়ি রয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় শত কোটি টাকা। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাঁচারের বিষয়ে অভিযোগ রয়েছে। জেলা রেজিস্ট্রার পদে যোগদানের পর থেকে বদলী বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন তার ছেলে শামীম ইয়াসার স্পন্দন। তিনি দোহার , গুলশান ও রুপগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে কর্মরত থাকাবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িয়ে পড়েন বলে জানা যায়।

সাবিকুন নাহার বিভিন্ন অফিসে রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদানের পর ভূয়া মালিক সাজিয়ে জাল দলিল, জমির দাম কম দেখিয়ে সরকারী রাজস্বঁ ফাঁকি দিয়ে নিজে অর্থ আত্মসাত করেন,জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ক্রেতা-বিক্রেতার নিকট থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আবার অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঁচার করার অভিযোগে দুদকে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান। যদিও তদন্ত ঢিমেতালে চলছে বলে অনেক সাব-রেজিস্ট্রার অভিযোগ করেন।

দোহার সাব-রেজিস্ট্রি অফিস :

দেশে ২০০৭ সালে জরুরী অবস্থা চলাকালীণ সময়ে সাবিকুন নাহার দোহার সাব-রেজিস্ট্রার দোহার সাবরেজিস্ট্রি অফিসে কর্মরত ছিলেন। দোহার অফিসে নিয়ম বর্হিভূতভাবে দলিল করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অর্থ আত্মসাত করার অভিযোগ ও প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেনের সময় যৌথ বাহিনীর হাতে ঘুষসহ ধরা পড়েন সাবিকুন নাহার। তৎকালীণ আই জি আর মাজদার হোসেন সুষ্ঠু তদন্ত করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সাবিকুন নাহারকে ছাড়িয়ে আনেন। তার কর্মকান্ডের জন্য পিয়ন ও অফিস সহকারীকে কারাবাসে যেতে হয়।

রুপগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিস :

সুচতুর সাবিকুন নাহার যেসব অফিসে বার্ষিক বেশী জমি দলিল সম্পাদিত হয় উৎকোচের বিনিময়ে সেই অফিসগুলোতে পদায়ন নেন। রুপগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিস নারায়ণগঞ্জ জেলার সর্বোচ্চ দরিল সম্পাদিত হওয়ার কারণে নানা কৌশলে সাবিকুন নাহার দ্রুত রুপগঞ্জ অফিসে যোগদান করেন। যত বেশী দলিল তত বেশী দুর্নীতি আর আয় করতে থাকেন সাবিকুন নাহার যা তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়। ২০১৪ সালে রুপগঞ্জে থাকাকালীণ সময়ে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে মামলা হয়। সম্পাদিত দলিল দুইটি নম্বর হল-৪০৫২ ও ৪৫২৭,যেখানে তিনি জমির প্রকৃত শ্রেণী পরিবর্তন করে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজেই টাকা আত্মসাত করেন। এবিষয়ে দুদক মামলা করে বলে অভিযোগ সূত্রে জানা যায়। মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় সাবিকুন নাহারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিভাগীয় মামলার তদন্তভার দেয়া হয় তৎকালীণ সময়ের আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতামত শাখা-৩ এর উপ-সচিব উম্মে কুলসুমকে। দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে মন্ত্রণালয় তাকে তিরস্কারমূলক শাস্তি প্রদান করে। যা পরবর্তীতে অনেক বির্তকের সৃষ্টি করে।
গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিস: মানদন্ডের হিসেবে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোর মধ্যে এলিট ও ব্যয় বহুল অফিস গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিস। সাবিকুন নাহার বিপুল পরিমান উৎকোচের বিনিময়ে গুলশান সাবরেজিস্ট্রি অফিসে যোগদান করেন। গুলশান এলাকার বিভিন্ন জমি , ফ্ল্যাট ও বাড়ি দাম কম দেখিয়ে বা বাজারদরের চেয়ে কম মূল্য দেখিয়ে সরকারি কোষাগারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বিপুল পরিমান অবৈধ অর্থ উপার্জন করেন। গুলশানে কর্মরত থাকাকালীণ ৩ অক্টোবর ২০১১ সালে ৯১৫০ দলিলটি করতে ২ কোটি টাকা ঘুষ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল করার অভিযোগে ২০১৬ সালে ৮ নভেম্বর বনানী থানায় একটি মামলা হয়। যাহার মামলা নং-৬। পরবর্তীতে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হন দুদকের উপ-পরিচালক সুভাষ চন্দ্র দত্ত। কিন্তু তদন্ত ধামাচাপা দিতে সর্বোচ্চ চেস্টা চালিয়ে যান সাবিকুন নাহার। আরো বিভিন্ন দলিলে জাল-জালিয়াতির জন্য তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ হয়।

দুদকের উপ-পরিচালক ফয়সাল কাদের তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। দলিল নং-৬৯৭৮ সম্পাদনের তারিখ ১১ সেপ্টেম্বর ২০১২ , দলিল নং-৯৩৫৫ সম্পাদনের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১২, দলিল নং-২৯২২ সম্পাদনের তারিখ ৪ এপ্রিল ২০১২। এই দলিলগুলো সম্পাদনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের জালিয়াতির বিষয়টি প্রতীয়মান হওয়ায় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে উক্ত দলিলগুলোর তথ্য প্রদানে তালবাহানা করে সংশ্লিষ্ট অফিস সমূহ। কর্ম জীবনে সীমাহীন দুনর্িিতর পরেও সাবিকুন নাহার পদন্নোতি পেয়ে বর্তমানে ঢাকা জেলা সাব-রেজিস্ট্রার। অভিযোগের বিষয়ে সাবিকুন নাহারের সাথে ফোনে ও অফিসে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম