টেকসই কৃষিপণ্য নিয়ে বিশ্ববাজারের লক্ষ্য প্রান্ত অ্যাগ্রোর

স্টাফ রিপোর্টার:

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন বিষয়। যা মানবজীবনে শান্তি ও স্বস্তির যোগান দিচ্ছে। উন্মুক্ত করছে গবেষণার নতুন দ্বার। নদীমাতৃক বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষিনির্ভর জীবিকায় জড়িয়ে আছে। দেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান অনস্বীকার্য। দেশে আধুনিক ও স্মার্ট কৃষির সম্ভাবনাও প্রবল। কৃষিতে অফুরন্ত সম্পদ থাকার পরেও নিরঙ্কুশভাবে তা কাজে লাগছে না।

দেশের বেশিরভাগ কৃষক এখনো বাপ-দাদার দেখানো পথে চাষাবাদ করছে। এতে করে খরচ ওঠাতে পারলেও বেশিরভাগ সময় লোকসান গুনতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফল-ফসলাদির আবাদ কমে গেছে। কমে আসছে আবাদি জমিও। অথচ বছরে এখন এক জমিতে একাধিক আবাদ হচ্ছে। এ সংক্রান্ত অনেক তথ্যই জানেন না কৃষক! আবার জানলেও তা আমলে নেন না।

বর্তমান সময়ে দেশের কৃষিকে আধুনিকায়ন করতে ও কৃষকদের আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দিতে সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোক্তা বা বেসরকারিভাবে কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। সরকারিভাবে যা হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোক্তাদের অনেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আধুনিক ও স্মার্ট কৃষির সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছেন।

প্রান্তিক কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, বীজের জাত, জমি প্রস্তুত প্রণালী থেকে ফসল বাজারজাতকরণ সম্পর্কে হাতে-কলমে শেখাতে প্রতিবছর প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে আসছে প্রান্ত অ্যাগ্রো রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (পিএআরএডিআই)।

গেল ২৭ জানুয়ারি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় ‘প্রান্ত অ্যাগ্রো’ তাদের প্রকল্প এলাকায় কৃষি বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করে। এতে প্রায় দুইশ প্রান্তিক কৃষক অংশ নেন। দিনব্যাপী এ কর্মশালায় প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন মেঘনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহ আলম। এ ছাড়াও প্রান্তিক কৃষকদের মাঠ প্রশিক্ষণ দিয়েছেন গার্ডেন ফ্রেশ বাংলাদেশ গ্রুপের প্রধান ইব্রাহিম মোশারফ।

আধুনিক কৃষির প্রতি প্রান্তিক কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন খুলনা অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ কৃষি উদ্যোক্তা শেখ ফয়সাল আহমেদ ও প্রান্ত অ্যাগ্রোর কৃষি কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। এ সময় অভিজ্ঞ কৃষিবিদ ও উদ্যোক্তারা আধুনিক কৃষি সম্পর্কে আলোচনা করেন। তারা কৃষকের নানা প্রশ্নের জবাব দেন। কর্মশালা শেষে মাঠে গিয়ে কৃষকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেন কৃষিবিদেরা।

কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার ওমরাকান্দা সেতু থেকে ১০ মিনিটের নৌপথ পাড়িয়ে দিলেই দেখা মিলবে সবুজে ঘেরা ‘প্রান্ত অ্যাগ্রো’ প্রকল্প। প্লট ভাগ করে বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি ফল-সবজি চাষ করা হয়েছে পুরো প্রকল্প এলাকা। বড়ই ও পেয়ারা ঝুলছে থরে থরে। বিদেশি ফল রকমেলন আর হানিডিউ দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।

বাগানে প্লট আকারে মালচিং পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে টমেটো, ক্যাপসিকাম, ক্যান্টালুপ, লেটুস, ক্ষিরাই ও কাঁচা মরিচ। একপাশে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হচ্ছে সূর্যমুখী ফুল। আরেকটা অংশে করা হয়েছে আঙুর ও বাদামের চাষ। জমিতে ব্যবহার করা হয় জৈব সার। বাগানের গাছগুলোতে নেই কোনো রোগবালাই। তাই ফলনও ভালো। আর প্লট আকারে ছোট-বড় পুকুরগুলোতে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন জাতের মাছ।

কর্মশালার দিন পুরো প্রকল্প এলাকায় ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। প্রায় দুইশ প্রান্তিক কৃষক, কৃষিবিদ ও অতিথিদের পদচারণায় মুখর ছিল। কৃষকরা প্লট ঘুরে ঘুরে দেখছেন আধুনিক পদ্ধতির কৃষিকাজ। কেউবা জমিতে নেমে হাত দিয়ে গাছের পাতা উল্টিয়ে গোড়া দেখেছেন। আধুনিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আসা কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বাপ-দাদার আমলের পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলেও আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তাদের জমিতে রোগবালাই লেগেই থাকতো। কর্মশালায় অংশ নিয়ে অনেক কিছু জেনেছেন। এখন থেকে প্রান্ত অ্যাগ্রোর কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে চাষাবাদ করবেন বলেও জানান তারা।

হরিপুরের কৃষক ইসমাইল আলী কয়েকবছর আগে চাষ করেছিলেন তরমুজ। কিন্তু তরমুজ চাষে তার পুরোটায় লোকসান গুনতে হয়েছে। তিনি জানান, প্রান্ত অ্যাগ্রোর তরমুজ চাষ দেখে তিনি তরমুজ চাষ শুরু করেন। খোলাবাজার থেকে বীজও সংগ্রহ করেন। কিন্তু বীজ থেকে গাছ হলেও আর ফল আসেনি। তিনি বলেন, কর্মশালায় এসে অনেক কিছু শিখলাম। শুধু বীজ কিনলেই হবে না, কোন জাতের বীজ কিনতে হবে সেটাও জানতে হবে।

মমিন ইসলাম নামের আরেক কৃষক বলেন, আমরা তো সব আগের নিয়মে চাষাবাদ করি। আধুনিক পদ্ধতি কি এগুলা জানি না। আমি মরিচ, টমেটো চাষ করতাম। এখানে এসে আধুনিক পদ্ধতির মরিচ আর টমেটো ক্ষেত দেখেছি। দেখলাম মাটিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে এসব চাষ করেছে, পোকার আক্রমণও কম। কিন্তু আমাদের ফলনে রোগবালাই লেগেই থাকে।

প্রান্ত অ্যাগ্রো রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেজার ফরিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কাজের মূল লক্ষ্য হলো গবেষণার মাধ্যমে কৃষির উন্নয়ন ঘটানো। নতুন-নতুন জাত বিশেষ করে বিদেশি জাতের উদ্ভাবন করা আমাদের লক্ষ্য, যাতে আমরা এর মধ্য দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারি। আমরা যে কাজগুলো করছি, সেগুলোর সাথে আমাদের কৃষক ভাইদের পরিচয় করে দিতে চাই। তাদেরকে এসবের সাথে সম্পৃক্ত করতে চাই। যাতে তারা প্রথাগত চাষ বাদ দিয়ে আধুনিক চাষাবাদের মাধ্যমে প্রত্যাশিত ফলন পায়।

প্রান্ত অ্যাগ্রোর কৃষি কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের কৃষক ভাইয়েরা এখনো তাদের বাপ-দাদার আমলের কৃষি থেকে বের হতে পারেনি। একটা জমিতে যে একাধিক ফলন পাওয়া যায় তারা সেটা জানে না। তারা জানে না কিভাবে একটা জমি থেকে বছরে দুই থেকে তিনটা ফসল পাওয়া যায়। ফলে তারা কোন লাভের মুখ দেখে না। প্রান্কি কৃষকদের আধুনিক কৃষি সম্পর্কে জানানোর জন্য আমাদের এই আয়োজন। আমরা চাই, আধুনিক উপায়ে চাষ করে লাভের মুখ দেখুক কৃষক।

উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বাড়াতে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি, নির্ভুল কৃষি এবং টেকসই পদ্ধতিতে কৃষকদের তাদের কৃষি পণ্যের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এক্সেস করতে সহায়তা এবং রপ্তানিতে উৎসাহিত করছে প্রান্ত অ্যাগ্রো। বিলুপ্তপ্রায় মহিশুর মাছ ও বাঙ্গি, মিষ্টি আলু ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে প্রান্ত অ্যাগ্রো রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (পিএআরএডিআই)।

মামা-ভাগনে গিলে খাচ্ছে মোহাম্মদপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস

স্টাফ রিপোর্টার॥

ঢাকার মোহাম্মদপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে কর্মরত একজন সাধারণ উমেদার—আব্দুল ছোবান। শুরু করেছিলেন মাত্র ৬০ টাকার হাজিরায়। অথচ আজ তিনি এক বিশাল সম্পদের মালিক। জমি, বাড়ি, গাড়ি—যা সাধারণ একজন সরকারি কর্মচারীর পক্ষে সম্ভব না, সেই অসাধ্যকেই সম্ভব করে তুলেছেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কীভাবে?

২৬ বছর ধরে একই অফিসে কর্মরত এই উমেদার সময়ের সাথে সাথে পুরো অফিসকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছেন। অফিসের ফাইল কার কবে যাবে, কত টাকা দিলে কোন দলিল কিভাবে সাজানো যাবে, কাকে আগে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে—সবই নির্ধারণ করে তার সিন্ডিকেট। এমনকি সাব-রেজিস্ট্রার পর্যন্ত অনেক সময় তার ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেন। অফিসের ভেতর ছোবানই শেষ কথা। শুধু চাকরি নয়, তিনি একেক সময় নিজেকে জমির দালাল, আবার কখনও রেজিস্ট্রারের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেন।

সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, তিনি নিজের ভাগ্নে আয়নাল হোসেনকে অফিসে নিয়োগ দিয়েছেন, যার কোনো সরকারি নিয়োগপত্র নেই। অথচ তিনিই অফিসের চাবি রাখেন, রাতের আঁধারে অফিস খুলে পুরোনো দলিল পাল্টে দেন, দাগ নম্বর বদল করেন, আর নকল কাগজ বানান। দিনের বেলায় যা সম্ভব নয়, তা রাতের অন্ধকারেই হয়ে যায়। এটা যে শুধুই বেআইনি নয়, দেশের ভূমি ব্যবস্থার ওপর ভয়ানক হুমকি—তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

এই দুর্নীতির বিনিময়ে ছোবান যা অর্জন করেছেন, তা যে কারো চক্ষু চড়কগাছ করে দেবে। বছিলায় তার ১৫ কাঠা জমি আছে যার মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। আদাবরে নিজের নামে ৬ তলা বাড়ি, কাটাসুর ও সাতারকুলে আরও জমি, দক্ষিণখানে বিশাল প্লট। তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে মিনিবাস, মাইক্রোবাস, এমনকি ইজিবাইক লাইনের মালিকানা রয়েছে। দেশের বাইরে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা, পরিবারসহ শপিং—সবই চলে এই ঘুষের টাকায়। শুধু অফিস থেকেই প্রতিদিন ১ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ ওঠে, মাসে যার পরিমাণ কোটি টাকা ছাড়ায়।

অথচ তার আয়কর নথিতে সম্পদের হিসাব মাত্র ৭৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। এই ভুয়া তথ্য দিয়ে তিনি শুধু সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেননি, বরং পুরো সিস্টেমকে বৃদ্ধাঙ্গুলিও দেখিয়েছেন। এমনই ক্ষমতার মালিক তিনি।

এই ঘটনা তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একজন সহকারী পরিচালক ইতোমধ্যে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো শাস্তি হয়নি। বরং অফিসে যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়, তারা বদলির ভয়, হুমকি আর চাপে পড়ে মুখ বন্ধ করে দেয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, একজন উমেদার যদি পুরো ব্যবস্থাকে কিনে ফেলতে পারে, তবে সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচার কোথায়? সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান তাহলে কেবল বক্তৃতাতেই সীমাবদ্ধ?

এখন সময় এসেছে সাহসিকতার সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার। এমন দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট যদি একবার ধরা না পড়ে, তবে শুধু মোহাম্মদপুর নয়—সারা দেশে এরা শিকড় গেড়ে বসবে। আব্দুল ছোবান একা নন, তিনি একটি চক্রের নাম, একটি সিস্টেমের প্রতিচ্ছবি। তাকে বিচারের মুখোমুখি না করা পর্যন্ত দেশের ভূমি অফিসগুলোতে সৎ কর্মকর্তারা নিরাপদ নন এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এখন সময় তার মতো দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দেওয়া এবং আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার। জনগণ তা-ই চায়।

এবিষয়ে বক্তব্য নিতে আব্দুল ছোবানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর তার ভাগ্নে আয়নাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। প্রথমে কল ধরলেও সাংবাদিক পরিচয় শুনে তিনি তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে দেন। পরবর্তীতে একাধিকবার কল দিলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম