স্বামী-স্ত্রী তে জিম্মি জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন

স্বামী-স্ত্রী-তে-জিম্মি-জাতীয়-প্রতিবন্ধী-উন্নয়ন-ফাউন্ডেশন

মাহতাবুর রহমান:
সারা দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে থাকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। ১৬ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে এনজিও হিসেবে কাজ শুরু করলেও ২০২৩ সালের জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইনের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর মিরপুর ১৪ নাম্বারে অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানে ২০০১ সালের জনাব মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম উচ্চমান সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে ও তার স্ত্রী জিয়াসমিন আক্তার সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ধাপেধাপে পদোন্নতি পেয়ে মফিজুল ইসলাম হয়েছেন সহকারি পরিচালক (প্রশাসন) এবং জিয়াসমিন আক্তার হয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা। দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানের একই কার্যালয়ে দুই স্বামী-স্ত্রী কাজ করার সুবাদে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা সহ সরকারি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করাও ভুলে গেছেন তারা।

 

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ নিজেও ২০২৪ সালের অক্টোবর মাস থেকে এই প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। জানাগেছে বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ সচিবালয়ে তার নিজ দায়িত্ব পালনের পরে মাঝে মধ্যে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে অফিস করেন আর এই সুযোগে অত্র প্রতিষ্ঠানকে মফিজুল ইসলাম ও জিয়াসমিন আক্তার (স্বামী-স্ত্রী) নিজেদের খেয়াল খুশি মতো চালাচ্ছেন।

 

যদি ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা পদ দীর্ঘদিনের শূন্য রেখে অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাঝে মাঝে অফিসে যাওয়ার মাধ্যমে ফাউন্ডেশন পরিচালনা সম্ভব হয় তাহলে এই পদের গুরুত্ব কোথায়?

 

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জিয়াসমিন আক্তার ও মফিজুল ইসলাম এর কর্মকান্ডের বেশকিছু তথ্য দৈনিক সবুজ বাংলাদেশের হাতে আসে। অনুসন্ধানের প্রথমেই জানা গেছে জিয়াসমিন আক্তার ১০ম গ্রেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার পদে থাকলেও তিনি ০৮ম গ্রেডের সহকারী পরিচালক (শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ) হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন ০৩ নভেম্বর ২০২২ সাল থেকে। ২ বছর আট মাস যাবৎ বিধি বহির্ভূত ভাবে এই দায়িত্বে আছেন তিনি।

 

• ১০ম গ্রেডের কর্মকর্তা কি ০৮ম গ্রেডের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেন?
• যদি দায়িত্ব পালনের বিধান থাকে তবে কতদিন দায়িত্ব পালন করতে পারেন?

 

চাকরির বিধানাবলীর চলতি দায়িত্ব ও অতিরিক্ত দায়িত্ব সংক্রান্ত নিয়মাবলীতে উল্লেখ আছে , জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শাখা (বিধি-১) এর ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ তারিখের স্মারক নং সম(বিধি-১)/এস-১১/৯২-৩০(১৫০) এর মাধ্যমে চলতি দায়িত্ব/অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান সংক্রান্ত সর্বশেষ যে নিয়মাবলী জারি করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে উক্ত বিধি মোতাবেক মন্ত্রণালয়/বিভাগ সাধারণত শূন্য পদে যথাক্রমে সমপদধারীকে অতিরিক্ত দায়িত্ব এবং নিম্ন পদধারীকে চলতি দায়িত্ব প্রদান করিয়া থাকেন। চলতি দায়িত্ব ও অতিরিক্ত দায়িত্ব সংক্রান্ত ১৮ এপ্রিল ২০২৩ তারিখের প্রজ্ঞাপনেও একই কথা বলা হয়েছে। তাহলে এই বিধান অনুযাযী ১০ম গ্রেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা জিয়াসমিন আখতার সহকারী পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন কিভাবে?

 

এই বিষয়ে জিয়াসমিন আক্তার বলেন ফাউন্ডেশন এর জনবলের স্বল্পতা ও দক্ষ জনবল আর না থাকায় তাকে এই দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসে এই দপ্তরে কি এতই দক্ষ জনবলের অভাব যে দশম গ্রেডের কর্মকর্তাকে অষ্টম গেটের দায়িত্ব পালন করতে হয়! নবম গ্রেডের কর্মকর্তাকে রেখে অষ্টম গেটের কর্মকর্তা কিভাবে জ্যেষ্ঠ হন?

 

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কর্মচারী চাকুরী বিধিমালা ৫ মে ২০১৬ তে প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটে উল্লেখ আছে কোন প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালকের ক্ষেত্রে সরাসরি নিয়োগ প্রাপ্ত হবেন ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা এবং পদোন্নতির মাধ্যমে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে পদোন্নতির ভিত্তিতে তিনজন সহকারী পরিচালক থাকলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জিয়াসমিন আক্তার ০৭ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে সহকারী পরিচালক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেছেন যা সম্পূর্ণ বিধি বহির্ভূত। বিধি বহির্ভূত আবেদন করেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের কর্মচারী চাকুরী বিধিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ আনিসুজ্জামান কোন অদৃশ্য কারণে এই ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জিয়াসমিন আক্তারকে সহকারী পরিচালক (শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ) এর অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন?

 

২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখের অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা আছে অতিরিক্ত দায়িত্ব দায়িত্বের স্থায়িত্ব ৬ মাসের অধিক হলে ৬ মাস অতিক্রমের পূর্বে অর্থ বিভাগে সম্মতির জন্য প্রেরণ করতে হবে। কিন্তু জিয়াসমিন আক্তার ০২ বছর ৮ মাস অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এখনো দায়িত্বে থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগকে অবহিত করেননি। তাহলে তিনি কি অর্থ মন্ত্রণালয়কে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করছেন?

 

এই বিষয়ে জিয়াসমিন আক্তার বলেন, অর্থ বিভাগকে অবহিতকরণের বিষয়টি আমার নিজ দায়িত্ব নয়। তাহলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করাকার দায়িত্ব এবং যার দায়িত্ব তিনি কি দায়িত্বের অবহেলা করেছেন?

 

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে যে জনবল নিয়োগ প্রদান করা হয় সেই নিয়োগ প্রক্রিয়াও নিয়ন্ত্রণ করেন মফিজুল ইসলাম ও জিয়াসমিন আক্তার (স্বামী-স্ত্রী)। এছাড়াও এই দপ্তরের বদলি বাণিজ্যও একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা। ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডের সকল বদলি অর্থের বিনিময় করেন এই দুই কর্মকর্তা। একই দপ্তরে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকায় এটা যেন তাদের ঘর বাড়ি হয়ে উঠেছে যখন যা খুশি তা করতে তারা মোটেও দ্বিধান্বিত হন না। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স বাসায় যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করেন এই ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জিয়াসমিন আক্তার।

 

অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারের বিষয়ে জিয়াসমিন আক্তার বলেন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় আমাদের একটি মাইক্রোবাসের মাধ্যমে সকলকে পৌঁছে দেয়া সম্ভব না হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারের জন্য বলেছিলেন। যেই অ্যাম্বুলেন্স রোগী পরিবহনের জন্য সেই অ্যাম্বুলেন্স কি কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে বহনের কাজে ব্যবহার হতে পারে? এছড়িাও জানাগেছে গত কুরবানিতে গরুর হাটে যাওয়ার জন্যও অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করেছিলেন এই দম্পতি।

মফিজুল ইসলাম ও জিয়াসমিন আক্তার বলেন, আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগ/সরবরাহের সকল নথি ও বদলি সংক্রান্ত নথি প্রশাসনিক কর্মকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত হয়ে সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) এর মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করা হয়।

সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) এর দায়িত্বে রয়েছেন মোঃ মফিজুল ইসলাম যার মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট নথি পেশ হয়, এবং এই সহকারী পরিচালকের স্ত্রী জিয়াসমিন আক্তার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। সুতরাং ফাইল তৈরি ও সর্বোচ্চ টেবিল পর্যন্ত উপস্থাপন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের এখানে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রয়েছে। এ যেন স্বামী-স্ত্রীর এক মজবুত শিকল।

 

এই সকল অপকর্মের মাধ্যমে মফিজুল ইসলাম ও জিয়াসমিন আক্তার (স্বামী-স্ত্রী) হাতিয়েছেন মোটা অংকের অর্থ যা দিয়ে তারা রাজধানীর বুকে কিনেছেন ফ্লাট। অনুসন্ধানে জানা গেছে মিরপুরের ইব্রাহিমপুর পর্বতা ঈদগাহ রোডে খান মঞ্জিল নামে একটি ভবনের আট তলায় তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে (হোল্ডিং নং-৯২৭/১)। স্বামী সহকারি পরিচালক(প্রশাসন), স্ত্রী ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এখন আবার বিধি বহির্ভূত ভাবে রয়েছেন অতিরিক্ত পরিচালকের দায়িত্বেও। সব মিলিয়ে এই স্বামী স্ত্রীর হাতেই জিম্মি জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন।

 

এই ফাউন্ডেশনের কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে চাইলে প্রথমে তারা কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের যখন নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় কখনোই কোনভাবে তাদের নাম প্রকাশ করা হবেনা তখন তারা এই মফিজুল ইসলাম ও জিয়াসমিন আক্তারের বিষয়ে এই প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা সত্য এবং এমন অনিয়ম দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে বলে স্বীকার করেন। এবং আরও বলেন সাংবাদিকের কাছে কে বলেছি তা যদি তারা জানতে পারে তাহলে আমার ক্ষতি হবে। প্রতিবেদককে জোড় অনুরোধ করে বলেন, ভাই আমি আপনাকে সত্যি বলেছি দেখবেন আমার যেন ক্ষতি না হয়।

 

জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে) বিজয় কৃষ্ণ দেবনাথ এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি ওখানে মাঝে মাঝে দুই একদিন যাই । প্রতিবেদনে উল্লেখিত এই সকল বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন আমি কয়েকদিন পর্যন্ত ওখানে যাইনি ওখানে গিয়ে আপনি যে মেইল পাঠিয়েছেন তা দেখে উত্তর দিতে পারব কিন্তু পরবর্তীতে তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কথা বলার সুযোগ হয়নি।

 

সম্প্রতি কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি নেয়ার চেষ্টা করছেন এই জিয়াসমিন আক্তার। কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতার যে তালিকা করা হয়েছে তাও লঙ্ঘিত হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানে।

গণপূর্ত বিভাগে শালা দুলাভাইয়ের রমরমা টেন্ডার বাণিজ্য….

স্টাফ রিপোর্টারঃ

গণপূর্তের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বিরুদ্ধে টেন্ডারের তথ্য আগাম ফাঁস করে তার শ্যালকের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’কে কোটি কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গণপূর্তের সার্কেল-৩ ই/এম শাখার কোন কাজের টেন্ডার হলেই তার অনুমোদন পেতেন ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’। আবার এই টেন্ডারগুলোর অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ ছিলেন প্রকৌশলী আবুল কালাম। অতি অল্প সময়ের মধ্যে শ্যালকের এই প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় অর্ধশতাধিক টেন্ডারের অনুমোদন দেওয়ায় তালিকাভুক্ত অন্যান্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোন সরকারি কর্মকর্তা নিজে বা পরিবারের বা আত্মীয় স্বজনের মাধমে তার প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কোন ঠিকাদারি কাজে নিযুক্ত হওয়ার আইনগত বিধান না থাকলেও প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ নিজের শ্যালক সাইফুল ইসলাম খানের নামে একটি ঠিকাদারি ফার্ম খুলে গণপূর্তের কোটি কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছেন। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে প্রকৌশলী আবুল কালাম তার অধীনস্ত কর্মকর্তাদেরকেও এই প্রতিষ্ঠানে নামে কাজের অনুমোদন দিতে বাধ্য করতেন। যদি কোন নির্বাহী প্রকৌশলী তার কথা না শুনতেন তাহলে তাকে হয়রানিমূলকভাবে অন্যত্র বদলি করে দিতেন। এমনকি তার চাকরিও খেয়ে ফেলার হুমকি দিতেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গণপূর্ত ই/এম সার্কেল-৩ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালামের আপন শ্যালক সাইফুল ইসলাম খানের ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রকৌশলী আবুল কালাম তার আওতাধীন বিভিন্ন নির্বাহী প্রকৌশলীকে এই শ্যালকের প্রতিঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতেন। গণপূর্ত ইএম বিভাগ-৮ এর অন্তত ২০টি কাজের টেন্ডার দিয়েছেন শ্যালকের প্রতিষ্ঠানকে। আবার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এই কাজগুলো অনুমোদন করেছেন আবুল কালাম নিজেই। পিপিআর-২০০৮ ধারা ১১৯ (২) অনুযায়ী এ ধরনের অনুমোদন সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করা হয়েছে। আবার রাজস্ব বাজেটে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে আবুল কালামের অনুমোদনের ক্ষমতা ১২ লাখ টাকা হলেও শ্যালকের এই প্রতিষ্ঠানের নামে ২৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৬ টাকার কাজ নিজেই অনুমোদন দিয়েছেন। কালাম তার ঊর্ধ্বতন অফিসারের ক্ষমতা নিজেই প্রয়োগ করতেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে রাজস্ব বাজেটের ১২ লাখ টাকা প্রাক্কলন অনুমোদন করার ক্ষমতা আবুল কালামের হাতে থাকলেও কোস্টগার্ডের একটি কাজে ১ কোটি ২৬ লাখ ৮১ হাজার টাকার রাজস্ব বাজেটের একটি কাজ বিধিবহির্ভূতভাবে শ্যালকের প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন করেছেন।

আবহাওয়া অধিদফতরের রাজস্ব বাজেটের ৬৩ লাখ ২ হাজার টাকার ১টি, ৫৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকার ১টি ও ২২ লাখ ১২ হাজার টাকার ১টি কাজ ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে অনুমোদন দিয়েছেন শ্যালকের প্রতিষ্ঠানকে। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না আবুল কালাম এ ধরণের অসংখ্য ক্ষমতা বহির্ভূত কাজ করেই চলছেন। বিধি লঙ্ঘন করে আপন শ্যালকের ফার্ম ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়ে কালাম নিজেও হয়েছেন কোটিপতি।

আরো জানা গেছে, গণপূর্ত ই/এম সার্কেল-৩, শেরেবাংলা নগর, ঢাকায় বর্তমানে নিয়োজিত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ই/এম কারখানা বিভাগের ঢাকায় ‘মেসার্স ইনটিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’ ছয়টি কাজ দেওয়া হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পে। যার আইডি নং- ২১৪৯২৪, ২১৪৯২৪, ২১৮৩৩১, ৩৩৭৮১১, ১৩৭৯৯২, ১৪০২৬৭, ১৮৩১৪৯। এতে অনুমোদন দিয়েছেন গণপূর্ত ই/এম কারখানা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ ইসকান্দার আলী। পরবর্তীতে ৫টি আইডি গোপন রেখে একই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউচুপ ২৪.১২.২০২১ সালে এই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর নিকট কাজের তালিকা পাঠান। এই বিষয়ে গণপূর্ত ই/এম কারখানা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউচুপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন কথা বলতে চায়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি চাকরির আচরণ বিধিমালার ১৭নং বিধি অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীর পরিবারের কোন সদস্যকে তার আওতাধীন এলাকায় ব্যবসা করার অনুমতি না দেওয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়াও পিপিআর বিধি ১১৯(২) অনুযায়ী কোন আত্মীয়-স্বজন বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে এমন কাউকে কাজ দেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তার শ্যালকের জন্য অন্য ঠিকাদাররা কাজ পায় না। অনৈতিকভাবে কাজ দেওয়ার জন্য আবুল কালামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় খবরও প্রকাশিত হয়েছে। তাতেও টনক নড়েনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। আবার নিজ শ্যালকের ফার্মে কাজ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন দরপত্রে অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য আগেই বলে দিতেন শ্যালককে। ফলে অন্যান্য ঠিকাদারগণ মূল্য জানতে না পারার কারণে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার সুযোগ থাকতো না। বিটিআরসি ভবন নির্মাণ প্রকল্পে (দরপত্র আইডি- ৬১৮১৭৩) অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য কালামের শ্যালক সাইফুল দুলাভাইয়ের কল্যাণে আগেই জেনে যায়। পরে ১০ শতাংশ কমে দরপত্র দাখিল করে কাজ বাগিয়ে নেয়।
প্রকৌশলী আবুল কালাম অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য সংবলিত এই কাজের কপি ৮ সেপ্টেম্বর-২০২১ তারিখে পৃষ্ঠাংকন করে গণপূর্ত ই/এম সার্কেল-৩ নির্বাহী প্রকৌশলীর নিকট প্রেরণ করেন। অর্থাৎ এই অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য আগেই জানতেন। আর এটা শ্যালককে না বলা কোন অবকাশ থাকে না। উক্ত প্রাক্কলনের অধিকাংশ আইটেম শিডিউল বহির্ভূত আইটেম। কাজেই কোনক্রমইে অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আবুল কালামের শ্যালক সাইফুলের ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’ ছাড়া কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানই ১০ শতাংশ কমে দর মিলিয়ে দরপত্র দাখিল করতে পারেনি। এভাবে শ্যালকের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নিয়ে আবুল কালাম এখন শতকোটি টাকার মালিক।

সূত্র জানায়, রাজধানীর বনশ্রীতে আবুল কালামের ৫ হাজার বর্গফুটের একটি আলিশান ফ্ল্যাট, গুলশান নিকেতনে ২৫শ বর্গফুটের ২টি ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা আ/এ ডি-ব্লকে ৩টি ৫ কাঠার প্লট, নবীনগরে ৪৫ একর জমির সন্ধান মিলেছে এবং সম্প্রতি গ্রামের বাড়িতে করেছে আলিশান বাংলো, প্রিয় প্রাঙ্গণে রয়েছে ২৭ বিঘা জমি। এক কথায় সে এবং তার স্ত্রী এখন টাকার কুমির। কোন প্রকল্পের ইস্টিমেট অনুমোদন করাতে হলে তাকে ৪% এবং দরপত্র অনুমোদন করাতে হলে ২% টাকা কমিশন দিতে হয়। ফলে ঠিকাদাররা এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে লোকসানের মুখেও পড়ছে। এ কারণে দুর্নীতিবাজ আবুল কালামের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানান অন্যান্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো।

এই অভিযোগের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালামের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাকে তার দফতরে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তা পাঠালে তিনি কয়েক ঘণ্টা পর মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি এখন গ্রামের বাড়িতে আছি। আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে।’ যদিও পরে তিনি আর কথা বলেননি। গণপূর্তের প্রধান

প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, ‘অনেকের কাছ থেকে বিষয়টি শুনলাম। আমরা এই বিষয়ে তদন্ত করবো।’ দুর্নীতি দমন কমিশন ‘দুদক’র উপপরিচালক জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহাম্মদ আরিফ সাদেক বলেন, ‘গণপূর্তের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালামের একটি লিখিত অভিযোগ আমাদের দফতরে এসেছে। বিষয়টি তদন্ত চলছে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।’

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম