
ষ্টাফ রিপোটার
ট্যাংকলরিটি সাড়ে তের হাজার লিটার কিন্তু চুক্তিপত্রে দেখানো হয়েছে নয় হাজার। বাড়তি ধারণ সক্ষমতা গোপন রেখে চুক্তি করে তেল ‘চুরি’ করতে অভিনব জালিয়াতির এরকম ঘটনা সরকারি মালিকানাধীন জ্বালানি তেল বিপণন প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডেে অহরহ । অভিযোগ উঠেছে যমুনা অয়েলের তেল চুরির সিন্ডিকেটের মুল হোতা প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার অপারেশন হেলাল উদ্দিন৷ তার নেতৃত্বেই দীর্ঘ বছর ধরে তেল চুরির সিন্ডিকেটটি সক্রিয় এই প্রতিষ্ঠানটিতে। সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত আবুল হোসেন ( বর্তমানে জেল হাজতে) ফ্যাসিষ্ট সরকারের দোসর সিবিএ নেতা ইয়াকুব , ফতুল্লার ডিপোর জয়নাল আবেদীন টুটুলসহ আরও অনেকে ।
যমুনা অয়েল কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ট্যাংকলরিটির সাড়ে চার হাজার লিটার বাড়তি ধারণ সক্ষমতা গোপন করে চুক্তির ঘটনাটি অভিনব। উদ্দেশ্য লরিতে বাড়তি তেল দিয়ে ডিপোর বাইরে পাঠিয়ে চুরিতে করা। এদের আরও দাবী যমুনা অয়েলে এটা নতুন ঘটনা নয়, এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছে ।
এই জালিয়াতির সঙ্গে যমুনা অয়েল কোম্পানির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হেলাল উদ্দিন ছাড়াও একাধিক কর্মকর্তা ও ট্যাংকলরি মালিক জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠেছে।
যমুনা অয়েল কোম্পানি সূত্র বলছে, খুলনার দৌলতপুর ডিপো থেকে তেল পরিবহনের জন্য গত ২৭ জুলাই মেসার্স আছিয়া এন্টারপ্রাইজ, প্রোপাইটার মো : মানিক শেখ পিতা মো : নুর ইসলাম, খুলনা -যশোর রোড নতুন রাস্তা দৌলতপুর খুলনা, একটি ট্যাংকলরির সঙ্গে চুক্তি হয়। সেদিন থেকেই কার্যকর হয় চুক্তি পত্র। ১০ আগষ্ট যমুনা অয়েলের ডিজিএম ( অপারেশন) হেলাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে আছিয়া এন্টারপ্রাইজ মালিককে বলা হয় , যার সারমর্ম হলো , বিষয় পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য পরিবহনের জন্য ট্যাংকলরী নং ঢাকা মেট্রো ঢ – ৪২০০১২ ধারণ ক্ষমতা ৯.০০০ লিটার এর পরিবহন চুক্তি পত্র । পত্রের মুল বডিতে বলা হয়েছে আছিয়া এন্টারপ্রাইজের আবেদনের পরপ্রেক্ষিতে জেওসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মহোদয়ের সদয় অনুমোদনের প্রেক্ষিতে বিষোয়ক্ত ট্যাংকলরী খানা পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য পরিবহনের নিমিত্তে নতুন ভাবে চুক্তিপত্র সম্পাদনের মাধ্যমে যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডে এ অন্তুভুক্ত করা হলো , যা ২৭ জুলাই ২০২৫ থেকে কার্যকর, যার মেয়াদ আগামী ২৬. ০৭.২০২৮ তারিখ পর্যন্ত, অর্থ্যাৎ তিন বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
এদিকে চুক্তির কয়েক দিন পর ট্যাংকলরিটিতে করে বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ডিজেল পাঠানো হয়; কিন্তু ট্যাংকলরিটির ধারণ সক্ষমতায় অসামঞ্জস্য দেখতে পেয়ে ডিজেল গ্রহণে অসম্মতি জানান বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
সড়কপথে পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য পরিবহনের জন্য সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি যমুনা, পদ্মা ও মেঘনায় ট্যাংকলরি ভাড়ায় নেওয়া হয়। এ জন্য লরির প্রয়োজনীয় সব তথ্য ঠিক থাকতে হয়।
আছিয়া এন্টারপ্রাইজের ট্যাংকলরিটির ধারণ সক্ষমতার অসামঞ্জস্য ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল গ্রহণে আপত্তির খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন এই অসামঞ্জস্যতার বিষয়টি নিয়ে যমুনা অয়েল কোম্পানির কাছে আপত্তি জানান ট্যাংকলরির মালিক ও শ্রমিকেরা।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা ট্যাংকলরি শ্রমিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, সাড়ে ১৩ হাজার লিটারের লরি; কিন্তু জালিয়াতি করে দেখানো হয় ৯ হাজার লিটার। এটা করার কোনো নিয়ম নেই। এ কারণে মালিক-শ্রমিক সবাই আপত্তি জানিয়েছেন।
তেল পরিবহনের ভাড়া চুক্তি করার আগে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) থেকে লরির সক্ষমতা যাচাই (ক্যালিব্রেশন) করে সনদ নিতে হয়। নেয়াও হয়েছে তবে এতেও রয়েছে মহা জালিয়াতি। বিএসটিআই থেকে নেওয়া সনদের একটি প্রতিলিপি যমুনায় জমা দেওয়া হয়েছে। এতেও লরিটির তেল ধারণের সক্ষমতা ৯ হাজার লিটার দেখানো হয়েছে।সনদ অনুযায়ী, গত ২৫ জুন ক্যালিব্রেশন করে স্বাক্ষর করেছেন বিএসটিআই খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আলাউদ্দিন হুসাইন।
সনদটি যাচাই করতে বিএসটিআই খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ে যোগাযোগ করে হয়৷ কার্যালয় থেকে জানানো হয়, সনদে স্বাক্ষরকারী এই কর্মকর্তা গত জানুয়ারিতে ঢাকায় বদলি হয়ে গেছেন। তাই তাঁর স্বাক্ষর করার কোনো সুযোগ নেই। আসলে সনদটি জাল। সনদে থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করে ‘ঝিনাইদহ-ঢ-৪১-০০৩৮’ নম্বর গাড়ির ক্যালিব্রেশন প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া। এই গাড়িটিও আছিয়া এন্টারপ্রাইজের। মালিক নাম মো. মানিক শেখ।
মানিক শেখের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভুল করে বেশি ধারণক্ষমতার লরি দিয়ে কম তেল পরিবহনের চুক্তিটি করেছেন। বাড়তি তেল নেওয়ার জন্য লরির প্রকৃত ধারণ সক্ষমতা কম দেখাননি। আপত্তির কারণে তিনি চুক্তিটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে বেকায়দা পরে যায় যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডে কর্মরত কতিপয় অসাধু কর্মকর্তারা এবং লরির মানিক শেখ। নিজেদের রক্ষা করতে সমজোতা হয় দুই পক্ষের। মানিক শেখ ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক জটিলতার কারন দেখিয়ে চুক্তিটি বাতিলের আবেদন করেন৷
১৮ আগস্ট যমুনার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বরাবর চিঠিতে বলা হয়, ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক জটিলতার কারণে ট্যাংকলরিটি পরিচালনা করা যাচ্ছে না। তাই চুক্তি বাতিল করে জামানতের ৫ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
তবে সূত্র বলছে, জালিয়াতির বিষয়টি সামনে আসায় তড়িঘড়ি করে চুক্তিটি বাতিলের একটি চিঠি তৈরি করে যমুনা অয়েল। মানিক শেখের আবেদনের আগেই অর্থাৎ চিঠিটি ৩ আগস্ট চুক্তি বাতিলের সই করা দেখানো হয়। যদিও ১৭ আগস্টও ট্যাংকলরিটি ডিপো থেকে তেল পরিবহন করে। এরপর দ্রুত সংশোধন করে যমুনা অয়েল আরেকটি বাতিলের চিঠি দেয় ১৮ আগস্ট তারিখ উল্লেখ করে। এই চিঠিতেও স্বাক্ষর করেন ডিজিএম অপারেশন মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন । আছিয়া এন্টারপ্রাইজ বরাবর এবারের চিঠির মুল বিষয় বস্তু হলো , বিষয় দৌলতপুর ডিপোতে ট্যাংকলরি ঢাকা মেট্রো ঢ ৪২০০১২ এর পরিবহন চুক্তি বাতিল প্রসঙ্গে । চিঠির বডিতে চুম্বক অংশটুকু হলো ট্যাংকলরীটী আবেদনে ৯.০০০ লিটার ক্যালিব্রেশন এর কথা উল্লেখ থাকলেও মুলত আপনার ট্যাংকলরীটি ১৩.৫০০ লিটার, যেখানে ৯.০০০ লিটারের চেম্বার ২ টি হয় সেখানে ১৩.৫০০ লিটার হওয়াতে ৩ টি চেম্বার রয়েছে । আপনার ট্যাংকলরিতে তেল লোড দেয়ার সময় তেল ঘাটতির সম্ভবনা আছে৷। তাই চুক্তিটি বাতিল করা হলো । মজার বিষয় হলো আছিয়া এন্টারপ্রাইজ বলছে ব্যক্তিগত সমস্যার কথা আর যমুনা অয়েল বলছে তেল ঘাটতির সম্ভবনার কথা৷
দুটি চিঠির ভাষা একই। চিঠিতে বলা হয়, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদনের ভিত্তিতে ট্যাংকলরিটিকে তেল পরিবহনের অনুমতি দেওয়া হয়; কিন্তু ট্যাংকলরিটি ৯ হাজার লিটারের উল্লেখ করা হলেও এটি মূলত সাড়ে ১৩ হাজার লিটারের। ৯ হাজার লিটারের লরিতে দুটি চেম্বার থাকে। এই গাড়িতে তিনটি চেম্বার আছে। এতে যমুনা অয়েল কোম্পানি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই ট্যাংকলরির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হলো।
যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুস্তফা কুদরত-ই ইলাহী বলেন, বাস্তব ধারণ ক্ষমতা ও সনদের তারতম্যের কারণে লরিটির সঙ্গে চুক্তিটি বাতিল করা হয়েছে। চুক্তির আগেই বিষয়টি যাচাই করার কথা; কিন্তু কোন পরিপ্রেক্ষিতে, কীভাবে এটা হলো তা তদন্ত করা হবে।
চুক্তি বাতিলে একাধিক চিঠি ও চুক্তি বাতিল নিয়ে দুই পক্ষের ভিন্ন বক্তব্যের বিষয়ে তদন্তের পর মন্তব্য করবেন বলে জানান মুস্তফা কুদরত-ই-ইলাহী।
তবে যমুনা অয়েল কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, চুরির তেল ট্যাংকলরিতে করেই ডিপোর বাইরে যায়। প্রতি লরিতে কিছু কিছু করে বাড়তি তেল দিয়ে দেওয়া হয়। চুরির এই তেল পরে কারিগরি ক্ষতি হিসেবে দেখানো হয়। ফলে লরির সাড়ে চার হাজার লিটার বাড়তি সক্ষমতা গোপনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট। কারণ, যমুনায় জ্বালানি তেল চুরির ঘটনা নতুন নয়। ( চলবে)