পুলিশ খুন করেনি? তাহলে কে খুন করেছে ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক মেহেদীকে?

স্টাফ রিপোর্টার:
ঢাকা টাইমসের সাংবাদিক হাসান মেহেদীকে পুলিশ গুলি করেনি বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তাহলে তাকে গুলি করল কে? কার গুলিতে প্রাণ ঝরল ঢাকা টাইমসের এই মেধাবী সাংবাদিকের?

গত ১৮ জুলাই বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে যাত্রাবাড়ীর কাজলায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজার ওপরের অংশে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশের ছোরা গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক মেহেদী। প্রায় ১০ মিনিট পড়ে থাকার পর তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে আনা হলে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন দায়িত্বরত চিকিৎসক।

ওই ঘটনার ১৭ দিন পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করলেন, ‘পুলিশের গুলিতে কোনো সাংবাদিক মারা যায়নি।’ এমনকি তিনি এও বলেছেন, ‘আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কেউ মারা যায়নি।’

সচিবালয়ে শনিবার রাতে সমসাময়িক বিষয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন দাবি করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর সঙ্গত কারণেই বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে আসে ।

তাহলে কার গুলিতে সাংবাদিক নিহত হলেন? দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তার এখন এটাও জানানো উচিত, পুলিশ গুলি না করলে কে গুলি করল মেহেদী হাসানকে।

নিহত সাংবাদিক হাসান মেহেদীর বুকে-পিঠে অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন। সাধারণত আন্দোলন-সংগ্রামে এই গুলি ব্যবহার করে পুলিশ। ছররা গুলি পুলিশ ছাড়া আর কেই-বা ব্যবহার করে? এই জবাবও তো তার কাছ থেকেই আসতে হবে।

এমনকি হাসান মেহেদী গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শী অন্য সাংবাদিকদের বয়ানেও পুলিশের গুলি করার কথা উঠে এসেছে নানা মাধ্যমে।

এ ছাড়া ছাত্র আন্দোলন ঘিরে হত্যা ও সহিংসতার ঘটনা তদন্তে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ কমিটির তদন্তাধীন বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনসমক্ষে কোনো পক্ষে মন্তব্য করতে পারেন কি?

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে অমূলক বলছেন বিশ্লেষকরা। কোনো হত্যার ঘটনায় তিনি এভাবে আগেভাগে মন্তব্য করতে পারেন না। তিনি এর মধ্য দিয়ে মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা পুলিশকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিলেন। তা না হলে সাংবাদিক হত্যায় পুলিশের পক্ষে এভাবে সাফাই গাইলেন কেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান আসিফ নজরুল বলেন, সরকার এভাবে সব সময় নিজেদের দায়মুক্ত রেখে দেশকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। সাংবাদিক হত্যা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য সম্পূর্ণ অমূলক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন বিশ্লেষক বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই এভাবে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দেন, তাহলে পুলিশের পক্ষে এর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা সম্ভব হবে না। পুলিশের কী সাধ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের বাইরে গিয়ে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে?

তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিক হাসান মেহেদীসহ সব হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য নির্দেশ দেবেন, এবং প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনবেন বলে আশা করেন বিশ্লেষকরা।

চট্টগ্রামে এমএলএমের আদলে প্রতারণার ফাঁদ, টার্গেট নতুন সদস্য

স্টাফ রিপোর্টারঃ

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার গোলাপাহাড় মোড়ের একটি ভবনে ‘সেলফ এমপ্লয়মেন্ট টেকনোলোজি লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানের সুসজ্জিত অফিস। নির্ধারিত ফি নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধন করানো হয় গ্রাহকদের। তাদের বেশিরভাগ গ্রাহক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বিনিময়ে তাদের বিভিন্ন সুবিধা এবং কাজের সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু আদতে এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এভাবে কোটি টাকা তুলে একবার এ প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলেও পরে আবারও এমএলএমের আদলে নতুন রূপে হাজির হয়ে ফাঁদ পাতে প্রতারণার।

জানা গেছে, এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় আছেন তিন ভাই শাহদাৎ হোসেন শাহীন, ইমাম হোসেন ও শামীম। তাদের বাড়ি মিরসরাইয়ে। একশ্রেণির যুবকদের অল্প সময়ে কোটিপতি হওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মাত্র ৫০০ টাকায় নিবন্ধন করানো হয় ‘সেলফ এমপ্লয়মেন্ট টেকনোলোজি লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানটিতে। নিবন্ধনের পর কোনো ধরনের বিনিময় ছাড়া টাকা আয়ের কিছু ‘টেকনিক’ শিখিয়ে বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয় গ্রাহকদের। তবে প্রতিষ্ঠানটির টার্গেট শুধু সদস্য বাড়ানো। এভাবে সারাদেশ থেকে কয়েক বছরে তাদের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখের কাছাকাছি। এভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্তত পাঁচ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানটিতে ৫০০ টাকায় নতুন গ্রাহক হলে আয়ের অর্থ বিপরীতে তারা ২০০ পয়েন্ট পান। সেই গ্রাহক অন্য কাউকে সদস্য বানালে পান কমিশন। এভাবেই এমএলএম ব্যবসার আদলে পরিচালিত হয় প্রতিষ্ঠানটি। সেক্ষেত্রে একজন গ্রাহক অন্যজনকে গ্রাহক বানালে পান ১৯০ টাকা। বাকি অর্থ যায় প্রতিষ্ঠানের খাতায়।

গ্রাহক হওয়ার পর অনেকে লোভে পড়ে বিনিয়োগ করতে থাকেন। এমনকি পরিচিত মানুষদেরও নিবন্ধন করান প্রতিষ্ঠানে। এখানে গ্রাহকরা বিনিয়োগ করলে তাদের দেওয়া হয় ‘পয়েন্ট’। এ পয়েন্ট দিয়ে টাকা উঠানো যায় প্রতিষ্ঠান থেকে। এভাবে অনেক মানুষ এখানে বিনিয়োগ করলেও শেষ পর্যন্ত প্রতারিত হয়েছেন প্রতিষ্ঠানের হাতে। আর নিবন্ধনের ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকা হারিয়ে অনেকে অল্প টাকার জন্য পুলিশে অভিযোগ দেন না।

আরও জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীর ওয়াসার মোড়ে শুরুতে ‘সেলফ এমপ্লয়মেন্ট ডটকম’ নামের একটি সাইট খুলে প্রতিজন গ্রাহক থেকে ১৫০০ টাকা করে নিবন্ধন ফি নেওয়া হয়। এভাবে প্রায় ৫০ হাজার গ্রাহক থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় অন্তত সাড়ে সাত কোটি টাকা। মোটা অংকের টাকা সংগ্রহের পর সুকৌশলে সাইটির বন্ধ করে দেয় তারা।

পরে ২০২০ সালের জুনের দিকে চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোডের ইম্পালস সিটি সেন্টারে ষষ্ঠতলায় ‘সেলফ শপিং ডটকম’ নাম দিয়ে নতুন করে আবারও যাত্রা শুরু করে তারা।

ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, সরাসরি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যবহৃত এক ধরনের বাজারজাতকরণ কৌশল যাতে বিদ্যমান পরিবেশকগণকে নতুন পরিবেশক নিয়োগে উৎসাহিত করা যাবে না।

কিন্তু এক্ষেত্রে একজন গ্রাহক নিবন্ধন হওয়ার পর আরেকজনকে নতুন গ্রাহক তৈরি করতে উৎসাহিত করছে প্রতিষ্ঠানটি।

পাপন নামের এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলেন, ‘অনলাইনে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে দেখে ২০১৯ সালে ১৫০০ টাকা জমা দিয়ে কাজ শুরু করি। টাকা দেওয়ার পর আমাকে নিবন্ধন করে তারা। সেখান থেকে বলা হয়, লোক দিতে পারলে ইনকামের পয়েন্ট পাওয়া যাবে। আমি কয়েকজনকে ভর্তি করাই। সেখানে কয়েকশ’ পয়েন্ট পেয়েছি। ১০০০ থেকে ২০০০ পয়েন্ট জমলে টাকা উঠানো যেত। তবে সদস্য ফি বাবদ কোনো বিনিময় পাইনি।’

তিনি বলেন, ‘আমি যাদেরকে ভর্তি করিয়েছি, তারাও আমার মতো। অর্থাৎ একজন গ্রাহক নতুন গ্রাহক ঢোকালে আয়ের পয়েন্ট ওঠে। ওখানে টাকা বিনিয়োগের লোভ দেখায় তারা। কিন্তু একবার টাকা বিনিয়োগ করলে তা আর পাওয়া সম্ভাবনা নেই।’

প্রতিষ্ঠানটির আরেক সদস্য টুটুল বলেন, ‘২০১৮ সালে ১৫০০ টাকা দিয়ে সেলফ এমপ্লয়মেন্টের সদস্য হয়েছি। নিবন্ধন হওয়ার পর অনলাইনে বিজ্ঞাপন ক্লিক করলে আয়ের পয়েন্ট পাওয়া যাবে বলে জানায় তারা। কিছু পয়েন্টও পেয়েছি। সেই অনুযায়ী কিছু টাকাও পেয়েছি। তবে ১৫০০ টাকা নিবন্ধন হওয়ার বিনিময়ে কোনো পণ্যমূল্য পাইনি। বড় বড় স্বপ্নের লোভ দেখাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বাস্তবে তার কোনো কিছু নেই।’

জানতে চাইলে সেলফ এমপ্লয়মেন্ট টেকনোলোজি লিমিটেডের পরিচালক ইমাম হোসেন  বলেন, ‘আমি অফিসে যাই না। এটা আমার ভাই পরিচালনা করে। এ বিষয়ে উনাকে ফোন করে বিস্তারিত জানতে পারবেন।’

প্রতিষ্ঠানের আরেক পরিচালক শাহাদাৎ হোসেন শাহীন  বলেন, ‘আমরা গ্রাহকের কাছ থেকে যে টাকা নিই, ওটার বিনিময়ে গ্রাহকদের ব্যবসার সুযোগ দিচ্ছি। কিন্তু পণ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে না। তাদের ট্রেনিং ও টাকা আয় করার পথ দেখানো হচ্ছে। অনেকেই টাকা ইনকাম করছেন।’

২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট বন্ধ করার কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘বন্ধ করা সাইটটির গ্রাহকদের মুভ করা হয়েছে নতুন ওয়েবসাইটে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমান বলেন, ‘আমি ছুটিতে রয়েছি। বিষয়টি এখনই ওসি সাহেবকে জানাচ্ছি। তিনি বিষয়টি দেখবেন।’

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম