নতুন বছরে জনগণের প্রত্যাশা

স্টাফ রিপোর্টারঃ

রংপুরের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের আত্মত্যাগের পথ ধরে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, মজুরসহ শত শত মানুষ বন্দুকের নলের সামনে বুকে পেতে দাঁড়ানোর নজিরবিহীন সাহস দেখান, যার পরিপ্রেক্ষিতে সাড়ে ১৫ বছরের দোর্দ- প্রতাপে শাসনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। দেশের ইতিহাসে ২০২৪ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি বছর। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও ২০২৪ সালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের হাত থেকে দ্বিতীয়বার স্বধীনতা লাভ করে। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে সৃষ্টি হয় গণঅভ্যূত্থান। বাংলাদেশ পায় স্বাধীনতা। গত ৫ আগস্ট দেশের আকাশে উদিত হয় বিজয়ের রক্তিম সূর্য। হাজার হাজার জনতার ত্যাগ-তিতিক্ষায় বাংলাদেশ আবারো পায় মুক্তির স্বাদ। ফিরে পায় বাকস্বাধীনতা। ছাত্র-জনতার সর্বসম্মতিত্রমে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় দেশ পরিচালনার। দায়িত্ব নেয়ার পর সরকারের সামনে এসে দাঁড়ায় রাষ্ট্র সংস্কারের বিরাট চ্যালেঞ্জ। বছরের শেষ কয়েকমাস সরকার দেশের বিভিন্ন সঙ্কট মোকাবিলায় চেষ্টা করছে। কিন্তু পতিত সরকারের দোসররা প্রতিনিয়ত তৈরি করছে নানান প্রতিবন্ধকতা। বিভিন্ন অধিকার আন্দোলনের নামে আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এতসব চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে ২০২৪ সাল শেষ হলেও নবাগত ২০২৫ সাল নিয়ে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশার কোনো কমতি নেই। নতুন বছরে দেশের জনগণ চায় ঢেলে সাজানো একটি দেশকে। মানুষ চায় একটি সুসজ্জিত-সুপরিকল্পিত বাংলাদেশ।

নতুন বছরে জনগণ চায় একটি দলীয় সরকার ব্যবস্থা। এ জন্য প্রয়োজন একটি গ্রহণযোগ্য অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে তৈরি করতে হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ। টানা সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামল ছিল স্বৈরতান্ত্রিক। ছিল না পরমতসহিষ্ণুতা, ছিল নির্যাতন-দমননীতি। অবাধ-সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তন করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। কিন্তু ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত করা হয় এটি। এরপর পরবর্তী তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দলীয় সরকারের অধীনে। আওয়ামী দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন এমপি হয়। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে চুরি হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচন হয় আমি আর ডামির মধ্যে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায়।

 

নতুন বছরে জনগণ চায় এমন একটি বাংলাদেশের যেখানে থাকবে না কোনো প্রকার দুর্নীতি। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশের অর্থনীতিকে করেছে পঙ্গু। দায়িত্ব নেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে আসে রিজার্ভ সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক প্রভাবে সঙ্কটাপন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক-অর্থনৈতিক নানামুখী সঙ্কট।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে অন্তত ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের কাছে স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এসব লুটপাটের মূল হোতা তথা রাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা প্রভাবশালীদের কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জিম্মি হয়ে পড়ে। বিগত সরকারের এমপি-মন্ত্রীসহ তাদের ঘনিষ্ঠজনদের কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ খেলাপি হয়েছেন। তাদের অনেকে নামে-বেনামে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮ গুণ। ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।

‘শিক্ষা জাতির মেরুদ-’। জাতির এই মেরুদ- ভেঙে দেশকে দাসত্বে পরিণত করতে ফ্যাসিস্ট সরকার বার বার করেছে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন। ফলে বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে চরম হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে। কো-কারিকুলামের প্রতি অধিক জোর দিয়ে মূল কারিকুলামকে করেছে অবজ্ঞা। ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসকে সংযুক্ত করে ধনী-গরিব ও শহর-গ্রামের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। নতুন নতুন পদ্ধতি যুক্ত করা হলেও শিক্ষকদের দেওয়া হয়নি সে অনুযায়ী পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ। তাই সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা নতুন বছরে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে, শিক্ষা খাতে সকল প্রকার দুর্নীতি রোধ করে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানঅর্জনের পথ সুগম করে দেওয়া।

বিগত সরকারের আমলে বাজার সিন্ডিকেটের কবলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। হতদরিদ্র থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের জীবন হয়ে পড়েছে দুর্বিসহ। গত ১০ বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হলেও দেওয়া হয়নি নতুন কোনো পে স্কেল। বাজার সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলে গেছে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন অতিবাহিত করেছে নিম্ন আয়ের মানুষ। এ সরকারের সময়ে অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। জনসাধারণের প্রত্যাশা, নতুন বছরে নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতায় আসুক। মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, হত্যা এগুলো নিত্যদিনের অপরাধে পরিণত হয়েছে। নতুন বছরে জনগণ চায় তার জীবন ও সম্পদের পূর্ণাঙ্গ নিশ্চয়তা।

দেশব্যাপী সড়কে যানবাহন বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে দুর্ঘটনাও। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের জন্য যথেষ্ট মাত্রায় প্রযুক্তির ব্যবহার না থাকায় এ সকল দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ৯ মাসে সড়কে নিহত হয়েছে ৫ হাজার ৫৯৬ জন। যার মধ্যে ৩৪ শতাংশের বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। এছাড়া আহত হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৬০ জন। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সবচেয়ে বেশি আঞ্চলিক সড়কে ৩৮.৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় মহাসড়কে ৩৩.৭১ শতাংশ এবং গ্রামীন সড়কে ১৪ শতাংশের বেশি। এছাড়া ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালে সড়কে নিহত হয় ৬ হাজার ৫২৪ জন। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধ, বেপরোয়া গতি রোধ, শক্তিশালী ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর সাঠিক বাস্তবায়ন এবং দক্ষ চালক তৈরির পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।

যানজট নিয়ে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি দিনদিন বেড়েই চলছে। রাজধানীর সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সকাল থেকেই মধ্যরাত পর্যন্ত লেগে থাকে এখন যানজট। ফলে কার্যদিবসগুলোতে অফিস, স্কুল-কলেজসহ প্রয়োজনীয় কাজে বের হওয়া প্রতিটি মানুষকে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। দশ মিনিটের দুরত্ব যেতে সময় লাগে ঘণ্টাখানেক বা এর চেয়েও বেশি। নতুন বছরে এসব ভোগান্তি থেকে মুক্তি চায় সাধারণ জনগণ।

সমাজের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সর্বক্ষেত্রে প্রশাসন ব্যবস্থাকে পুনরায় গঠন করা অতীব জরুরি। জনগণের প্রত্যাশা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে দেশের সরকারি বেসরকারি প্রতিটি ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি করা, যেন তারা জনস্বার্থে সঠিকভাবে কাজ করে। বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে সকল অমীমাংসিত মামলার বিচার কার্যসম্পাদন করে দোষীদের উপয্ক্তু শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। জুলাই আগস্টের গণহত্যাসহ বিগত সাড়ে ১৫ বছরে ঘটে যাওয়া প্রতিটি হত্যাকা- তথা অপরাধের সঠিক বিচার এখন সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি।

 

সবা:স:জু- ৫৯৪/২৫

রেলে অনিয়ম-দুর্নীতি সীমাহীন

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি॥
সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রীয় পরিবহন খাত রেলওয়ে সূচনালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখেনি। প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার উপর দিতে হচ্ছে গচ্ছা। কোনোভাবেই থামছে না রেলের দুর্নীতি। নিয়োগ, ইঞ্জিন, যন্ত্রাংশ, পর্দা, চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে সেনিটাইজারসহ ওয়াশিং সামগ্রী কেনাকাটা, এমনকি চলমান প্রকল্পগুলোর কাজেও ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি চলছে।

ধারাবাহিক এ লোকসানের জন্য রেলের অনিয়ম-দুর্নীতিকে দায়ী করে খোদ রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে রেল পরিচালনার ব্যয় ও আয়ের মধ্যে ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। পাশাপাশি বিদ্যমান সম্পদগুলো সুষ্ঠু ব্যবহার করে রেলকে সহজেই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যেত।

বর্তমানে টিকেট বিক্রিতে হয়রানি, অনিয়ম চরমে উঠেছে। টিকেট বিক্রিতে ‘সহজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান বারবার চুক্তিভঙ্গ করেও বহাল তবিয়তে আছে। প্রতিষ্ঠানটির খুঁটির জোর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলপথ বিভাগের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। রেলওয়ের একাধিক বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টেন্ডারের নিয়ম ভেঙে ‘সহজ’কে ট্রেনের ই-টিকেটের দায়িত্ব দেয়া হয়।

রেলওয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে আলোচিত ও ব্যাপক দুর্নীতি হয় নিয়োগের ক্ষেত্রে। এক একটি পদের বিপরীতে ৭-১০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার তথ্য তদন্ত রিপোর্টে উঠে এসেছে, যা নিয়ে রেলওয়ের বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা করেছে নিয়োগ বঞ্চিতরা। তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে- লিখিত পরীক্ষায় ১৩ পাওয়া প্রার্থীকে খাতায় নম্বর কেটে ৭৩ নম্বর লিখে দেয়া হয়, আবার ৯ পাওয়া প্রার্থীকে অর্থের বিনিময়ে ৮৯ নম্বর খাতায় লিখে দিয়ে চাকরিতে নিয়োগ করা হয়। এসবের বিরুদ্ধে চাকরি না পাওয়া প্রার্থীরা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। সে কারণে ওই পদে নিয়োগ বন্ধ হয়ে আছে দীর্ঘদিন। এর ফলে লোকবল সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ রেলওয়ে। এছাড়া রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে একজন কম্পিউটার ডাটা অপারেটর ভুয়া নিয়োগ দিয়ে মাসের পর মাস বেতন ভাতা বাবদ ৭০-৭৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন, যা সবার জানা। বর্তমানে তিনি হাজতবাস করছেন। কোন বিষয় মনিটরিংয়ের কেউ নেই।

সম্প্রতি ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরা পড়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে যুক্ত হওয়া ১০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) কেনার বিষয়ে। এ অভিযোগ যাচাইয়ে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ৩০ জুন রেল ভবনে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তার ও উপসহকারী পরিচালক মো. কামিয়াব আফতাহি-উন-নবীর সমন্বয়ে গঠিত এনফোর্সমেন্ট টিম এ অভিযান চালায়।

দুদক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে যুক্ত হওয়া ১০টি মিটার গেজ লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) কেনায় দুর্নীতি-অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযানকালে টিম সচিব ও মহাপরিচালকসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে। ট্রেনের ইঞ্জিন কেনার জন্য ২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য লোকোমোটিভ রিলিফ ক্রেন ও লোকোমোটিভ সিমুলেটর সংগ্রহ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এ প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফায় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।

রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, ইঞ্জিনগুলোতে তিনটি ক্যাপিটাল কম্পোনেন্টের ভিন্নতা আছে, যা চুক্তিবহির্ভূত। চুক্তিতে তিন হাজার হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন দেয়ার কথা থাকলেও ২ হাজার হর্স পায়ারের ইঞ্জিন দেয়া হয়েছে, টিএ-১২ মডেলের অল্টারনেটরের পরিবর্তে টিএ-৯ মডেল যুক্ত করা হয়েছে, এছাড়া ২৯০৯-৯ মডেলের পরিবর্তে ২৯০৯ মডেল দেয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়েকে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করে দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানি। দাম ছিল ৩২২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এরই মধ্যে ৯০শতাংশ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। সরকারের একটি সংস্থার প্রতিবেদন সূত্রে ওই অনিয়মের বিষয়টি সামনে আসে।

অভিযোগের তীর রেলওয়ের তখনকার মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী এবং ঠিকাদার আফসার বিশ্বাসের দিকে আসে। ইঞ্জিনগুলো প্রাক-জাহাজীকরণের দায়িত্ব দেয়া হয় চায়না সার্টিফিকেট এন্ড ইন্সপেকশন কোম্পানিকে (সিসিআইসি)। ২০২০ সালের ২৫ জুলাই ইঞ্জিনগুলো প্রাক-জাহাজীকরণ সমীক্ষা (পিএসআই) সনদ ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। সিসিআইসি ওই বছরের ১২ আগস্ট নিয়ম ভেঙে একই দিনে দুটি পিএসআই সনদ দেয়। ওই বছরের ৩১ আগস্ট ইঞ্জিনগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে এলে সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই খালাস করতে প্রকল্প পরিচালককে বাধ্য করা হয়। ইঞ্জিনগুলোতে নিম্নমানের ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট সংযোগ করার বিষয়টি সিসিআইসি ও হুন্দাই রোটেম গোপন রাখে। আবার কমিশনিং কমিটির প্রতিবেদনে ইঞ্জিনগুলোর বিভিন্ন ত্রæটির বিষয় তুলে ধরা হলেও ‘পারফরম্যান্স সন্তোষজনক’ বলে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া কমলাপুর ওয়ার্কশপে ইঞ্জিন মেরামতের যন্ত্রাংশ কেনা হয়েছে প্রচলিত বাজারমূল্যের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বেশি দামে। বাংলাদেশ রেলওয়ের অডিটেই উঠে আসে অনিয়মের এমন চিত্র। সদ্য সমাপ্ত রেলওয়ের অডিট বলছে, ২০২১ সালে কমলাপুর ওয়ার্কশপের ডিজেল বিভাগের কর্ম ব্যবস্থাপক রাশেদুল ইসলাম ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ কিনেছেন ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দামে। অডিটের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ট্রেনের জন্য ক্রয়কৃত গ্যাজব্রেক সিলিন্ডারের সর্বোচ্চ বাজারমূল্য ২ হাজার ৮৬০ টাকা, কিন্তু রেলওয়ে সেটির দাম ধরেছে ১৮ হাজার ৫০০ টাকা, গ্যাজ ভ্যাকুয়ামের সর্বোচ্চ বাজারমূল্য ১ হাজার ৮২০ টাকা, কিন্তু রেলওয়ে সেটির দাম দেখিয়েছে ২২ হাজার ৪৯০ টাকা। এ ছাড়া একটি সানবার রিংয়ের সর্বোচ্চ বাজারমূল্য ৫৮৫ টাকা, কিন্তু রেলওয়ে সেটির জন্য খরচ দেখিয়েছে দুই হাজার ৬৮৫ টাকা।

অন্যদিকে, একটি সানবার স্প্রিংয়ের দাম মাত্র ৪৫ টাকা অথচ রেলওয়ে এটি কিনতে খরচ দেখিয়েছে ৯১৮ টাকা। এভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র দেড় লাখ টাকা মূল্যের মালামাল কিনতে দাম দেখানো হয়েছে ১২ লাখ টাকা! এ বিষয়ে কেনাকাটার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলামকে জিঞ্জেস করা হলে তিনি বলেন, আপনি এবিষয়ে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জিঞ্জেস করেন। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রাশেদুল ইসলাম এখন কর্ম ব্যবস্থাপক (প্রকল্প) হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন রেল ভবনে। ট্রেনের লোকমোটিভের ব্যাটারি সচল রাখতে এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রচুর সালফিউরিক অ্যাসিডের প্রয়োজন হয়। গত দুই বছরে ৮০০ লিটার সালফিউরিক অ্যাসিড কেনার দাবি করেছেন রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী রেজাউল করিম। প্রতি লিটার সালফিউরিক অ্যাসিড কেনা হয়েছে ১৯৯৭ টাকা দরে। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সালফিউরিক অ্যাসিডের লিটার মাত্র ২০-২৫ টাকা। অর্থাৎ বাজার দরের চেয়ে প্রায় ৮০ গুণ বেশি দামে অ্যাসিড কিনেছে রেলওয়ে!

এদিকে, রেলের অনিয়ম-দুর্নীতির উৎস চিহিৃত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ২০১৯ সালে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জমা দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে সুনির্দিষ্ট বেশকিছু সুপারিশও প্রতিবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু এসব শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বাস্তবে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার পাশাপাশি আমলে নেয়া হয়নি দুদকের একটি সুপারিশও।

সম্প্রতি রেলে টিকিটের অনিয়মের প্রতিবাদে ৬ দফা দাবি নিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে অবস্থান করে আলোচনায় আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন রনি। তার এই একক প্রতিবাদে এই খাতের চিরাচরিত দুর্নীতির বিষয়টি আবারো সামনে আসে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষসহ সব মহলে তোলপাড় শুরু হলে বিষয়টি উচ্চ আদালতেরও দৃষ্টিগোচর হয় এবং আদালত তা আমলে নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বিষয়টি খোঁজ নিতে বলেন।

এ প্রেক্ষিতে গত ২১ জুলাই রেলের তিন কর্মকর্তা হাইকোর্টে হাজির হলে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার এই খাতের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, রেলে এত অব্যবস্থাপনা থাকবে কেন? কেন টিকেট কালোবাজারি হবে? আপনারা কি রেলকে গ্রাস করতে চাইছেন? সবশেষ হাইকোর্ট রেলের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে পদক্ষেপ জানতে চেয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে। এরই আলোকে রেল কর্তৃপক্ষ ছাদে যাত্রী ওঠা বন্ধ ও টিকিট কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণে একটি মনিটরিং সেল গঠন করে।

এর আগে দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে রেলে নিয়োগ, কেনাকাটা, টিকেট বিক্রি ও ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কাজে দুর্নীতিসহ রেলের ১০টি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির উৎস চিহিৃত করে রেলমন্ত্রীর কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় দুদক। ২০১৯ সালের ওই প্রতিবেদনে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রেলের বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিংসহ সুনির্দিষ্ট ১৫টি সুপারিশও সংযুক্ত করা হয়।

দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রেলের (পূর্বাঞ্চল) চট্টগ্রাম এবং (পশ্চিমাঞ্চল) রাজশাহীর অধীনে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়ে থাকে। রেলের অধীনে ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ ক্রয় ও সংগ্রহ ছাড়াও বিভিন্ন সেকশনের স্টেশন সিগনালিং ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও আধুনিকায়নে দুর্নীতি হয় বলে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। ডাবল লাইন, সিঙ্গেল লাইন, ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ কাজে ও রেলওয়ের ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কাজে দুর্নীতি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিএস সৈয়দপুর, নীলফামারী, বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল, পাকশী, বাংলাদেশ রেলওয়ে, লালমনিরহাট, পাহাড়তলী ও চট্টগ্রাম কর্তৃক বিজি ও এমজি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন নিলামে যন্ত্রাংশ বিক্রয় প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়।

রেলের অধীনে ওয়ার্কশপগুলো ও স্লিপার ফ্যাক্টরি কার্যকর না করে আমদানির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে অনিয়ম, রেলের টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে কালোবাজারি হয়ে থাকে এবং এ কালোবাজারিতে রেলওয়ের কর্মচারীরা অনিয়ম করে থাকেন। কতিপয় দালাল রেলওয়ের কর্মচারীদের সহযোগিতায় আন্তঃনগর ট্রেনের অধিক সংখ্যক টিকিট ক্রয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এর ফলে জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এছাড়া যাত্রীবাহী ট্রেন ইজারা দেয়া ও আন্তঃনগর ট্রেনসহ অন্যান্য ট্রেনে নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করে রেলের এক শ্রেণির অসাধু কর্মচারী দুর্নীতি করছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময় রেলে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে বেশ কয়েকবার সরেজমিনে অভিযানও পরিচালনা করে দুদক।

দুদকের প্রতিবেদনে সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- রেলের বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের (আইবিএ, বুয়েট, বিএমসি) সহায়তা নেয়া, সব ধরনের কেনাকাটা দরপত্রের মাধ্যমে করতে অভিজ্ঞ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব দেয়া, বেদখল হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন, দখলী জমি উদ্ধারে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সাঁড়াশি অভিযান চালানো। এছাড়া রেলওয়ের ওয়ার্কশপ সচল করা, কোচ আমদানি নিরুৎসাহিত করে নিজস্ব কারখানায় কোচ নির্মাণ করার সক্ষমতা সৃষ্টি করা, একচেটিয়া ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন (পিপিএ) অনুসরণ করা, বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন লাইন নির্মাণ ও সংস্কার কাজ তদারকি করা, অডিট কার্যক্রম জোরদার করা, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির মাধ্যমে রেলের পুরনো মালামাল বিক্রির ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া রেলের সব কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় (অটোমেশন) পদ্ধতির আওতায় আনা, টিকেট কালোবাজারি রোধে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার, রেল কর্মীদের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠাকে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা, যাত্রীসেবা বৃদ্ধি এবং নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করারও সুপারিশ করা হয়েছে। সবশেষ রেলে সরবরাহ করা খাবারের মান নিশ্চিত করতে তদারকির ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি যৌক্তিক দামে খাবার বিক্রি করতে বলেছে দুদক।

রেলের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দুর্নীতির উৎস চিহিৃত করে তা নিয়ন্ত্রণে দুদক অনেকগুলো সুপারিশ করেছে, এ সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে কর্মকর্তারা বলেন, এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। অথচ জনপ্রিয় এই পরিবহনের উন্নতির জন্য কর্তাব্যক্তিরা দিনের পর দিন শুধু প্রতিশ্রুতিই দিয়ে এসেছেন। বর্তমান রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে নূরুল ইসলাম সুজনও হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, রেলের দুর্নীতি তিনি শূন্যে নামিয়ে আনবেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, এখানে দুর্নীতি করে কেউ টিকতে পারবে না। তবে দুর্নীতি থামেনি, কাক্সিক্ষত উন্নয়নও হচ্ছে না রেলের।

এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও সচিব কে একাধিকবার ফোন দিলেও তারা রিসিভ করেননি। তবে, বেশ কিছুদিন আগে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন রেলের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে বলেছিলেন, রেলের কয়েকটি ক্রয়সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে অনিয়মের তদন্ত করছে দুদক। ইতিমধ্যে আমাদেরকে তারা একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেখানে বেশ কিছু সুপারিশও করেছে। আমরা নিজেরাও এ বিষয়গুলো তদন্ত করছি। ইতোমধ্যে আমরা কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা রেলে কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি বরদাস্ত করব না।

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম