
ডেস্ক রিপোর্ট:
জীবনের শেষ দিনগুলোতে ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক ও প্রাবন্ধিক আহমদ রফিক ছিলেন নিঃসঙ্গ। তবে চিরবিদায়ের দিনে তাঁর অগণিত অনুরাগী, সুহৃদ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন তাঁকে। বেদনাবিধুর হৃদয়ে মহানগরের দীর্ঘ পথ হেঁটে অনুগামী হলেন তাঁর অন্তিমযাত্রায়।
আজ শনিবার বেলা ১১টায় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বারডেম থেকে আহমদ রফিকের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয়। এর আগে থেকেই তাঁর গুণগ্রাহী ও সুহৃদেরা পুষ্পস্তবক নিয়ে ভারাক্রান্ত মনে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে অপেক্ষা করছিলেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম যে শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়েছিল, তার উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন সেই সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের তরুণ শিক্ষার্থী আহমদ রফিক। সেখানেই ৭৩ বছর পর শেষবারের মতো আনা হলো তাঁর নিথর মরদেহ। এখানে তাঁর কফিন ঢেকে যায় শ্রদ্ধার ফুলে। শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থাপনায় ছিল ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ফাউন্ডেশন। গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১২ মিনিটে বারডেম হাসপাতালে ৯৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তিনি ছিলেন বিপত্নীক ও নিঃসন্তান।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত সচিব আবুল ফয়েজ মো. আলাউদ্দিন খানের পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, ছাত্র যুব, স্বেচ্ছাসেবী, সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেকে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিককে অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন করে ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যদিও ভাষাসংগ্রামী হিসেবেই তাঁর পরিচয়টি প্রধান হয়ে উঠেছে, তবে তিনি ছিলেন আমাদের দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। একাধারে তিনি কবিতা ও প্রবন্ধ লিখেছেন। সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। আর রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে তাঁর কাজ উভয় বাংলায় অতিগুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। আজীবন তাঁর কাজ ও রাজনৈতিক ভাবনা ছিল সমাজের রূপান্তরের সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাঁর প্রয়াণ আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমাদের সংগ্রামের তিনি প্রেরণা হয়ে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।’
অধ্যাপক মনসুর মুসা প্রথম আলোকে আহমদ রফিক সম্পর্কে বললেন, তাঁর মতো দেশপ্রেমিক মানুষ এখন বিরল। সবাইকে ভালোবেসে, একত্র করে কাজ করতে পছন্দ করতেন তিনি। মানুষকে কেবল মানুষ পরিচয়ে, মিত্র হিসেবে গ্রহণ করতেন। এটাই প্রকৃত সমন্বয়। তাঁর মতো এমন সমন্বয়ধর্মী গুণের মানুষ আর সহজে পাওয়া যাবে না। সবাইকে নিয়ে একত্রে থাকার শিক্ষাই তিনি দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে ট্রাস্টি প্রাবন্ধিক মফিদুল হক বলেন, গণমানুষের মুক্তির জন্য যে আদর্শ আহমদ রফিক লালন করেছেন, তাতে ন্যায়নিষ্ঠ থেকেছেন। মেরুদণ্ড সোজা করে রেখেছেন। দেশ ভাগ তাঁকে ব্যথিত করেছিল। আজীবন সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ গড়ার চেষ্টা করেছেন। আর রবীন্দ্রনাথকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা করে জনমানুষের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে উপস্থাপন করেছেন। এ কারণে তাঁর গবেষণা বিশেষ মহিমা অর্জন করেছে। নিজের জীবনটাকেই তিনি মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছিলেন।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম একাডেমির পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রথম আলোকে বলেন, আহমদ রফিক একই সঙ্গে ভাষাসংগ্রামী ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনার জন্য অনন্য মর্যাদার অধিকারী। তিনি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জন্য আমৃত্যু কাজ করেছেন। তিনি শোভন, মার্জিত, ভদ্রলোকের জীবনযাপন করেছেন। নিজের সম্পত্তি অন্যদের মধ্য বিলিয়ে দিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের শেষে পরিবারের পক্ষে আহমদ রফিকের ভাতিজি রেহেনা আক্তার বলেন, আজ এখানে এত মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এসেছেন দেখে তাঁরা অভিভূত। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আহমদ রফিকের ভাগনে হুমায়ূন কবির অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, তাঁর মামা ছিলেন নির্মোহ মানুষ। দেশে বিভিন্ন সময় নানাভাবে তাঁর মামার সঙ্গে যুক্ত থেকে যাঁরা তাঁকে সহায়তা করেছেন, তাঁদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানান।
অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী বলেন, সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি যা ছিল, তা বিক্রি করে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যক্তি পর্যায়ে অনেককে দান করেছেন। নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবেননি। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে জীবনের শেষ দিনগুলো তাঁর ভালো কাটেনি। এখন সম্পদ বলতে রয়েছে তাঁর রচিত গ্রন্থ। তাঁর এই সম্পদ সমাজকে আলোকিত করেছে। এগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
স্মৃতিচারণা করেন তাঁর চিকিৎসক শাকিল আক্তার। সমাপনী বক্তব্যে ফাউন্ডেশনের সভাপতি মুনীর সিরাজ বলেন, নিঃসঙ্গ অবস্থায় কেটেছে আহমদ রফিকের জীবনের শেষ দিনগুলো। তবে আজ সেই নিঃসঙ্গতা নেই। এত মানুষ তাঁকে সঙ্গ দিতে, শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন, তা অভিভূত হওয়ার মতো।
বেলা একটায় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষ হয়। আগেই জানানো হয়েছিল ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক তাঁর মরদেহ ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দান করে গেছেন। মরদেহ নিয়ে শোকযাত্রা করেন তাঁর অনেক অনুরাগী। শহীদ মিনার থেকে দোয়েল চত্বর, শিশু একাডেমি, জাতীয় ঈদগাহের সামনে দিয়ে কদম ফোয়ারার মোড় ঘুরে তোপখানা রোড দিয়ে সেগুনবাগিচায় হাসপাতালে আসে শোকযাত্রা। হাসপাতালের চিকিৎসক আবু সাঈদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে মরদেহ হস্তান্তর করে বিষণ্ন চিত্তে ফিরে যান তাঁর অনুরাগীরা।