
মিজানুর রহমান, শেরপুর জেলা প্রতিনিধিঃ
শেরপুর গারো পাহাড় চষে বেড়াচ্ছে বন্যহাতির পাল! খেয়ে সাবার করছে কৃষকের ক্ষেতের কাঁচা-পাকা আমন ধান। মশাল জ্বালিয়ে রক্ষা করতে পারছেন না কৃষক ক্ষেতের ফসল।
ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ীর ৩ টি উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চলে এমন কোন রাত নেই যে, বন্যহাতি তান্ডব না চালাচ্ছে। আজ এই উপজেলা তো কাল অন্য উপজেলায় আমন ধানক্ষেতে তান্ডব চালিয়ে খেয়ে ও পায়ে মুড়িয়ে ধ্বংস করে চলেছে। অপরদিকে বনবিভাগ কেউ হাতির আক্রমণে মরলে ৩ লাখ, বাঁচলে ১ লাখ ও ফসলের ক্ষতি হলে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। শেরপুরের গারো পাহাড়ি অঞ্চলে ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর যাবত চলছে হাতি-মানুষের যুদ্ধ। প্রায় ৫০-৬০ কিলোমিটার এলাকায় বছরের পর বছর চলছে বন্য হাতির তান্ডব। বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। ফি-বছর বন্য হাতি খেয়ে ও পায়ে পিষে সাবাড় করছে কোটি কোটি টাকার বিপুল পরিমাণ জমির ফসল। ধ্বংস করছে বসতবাড়ি। খেয়ে সাবাড় করছে বাড়ির গোলার ধান। বন্যহাতির পাল পাহাড়ি অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে। ভেঙে তছনছ করে, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে খেতের ফসল, বসতবাড়ি।
দীর্ঘ ৩০ বছর চলে আসছে এই অবস্থা। জানা যায়, এতে হাতির পায়ে পৃষ্ঠ হয়ে মারা গেছে ৫৮ জন পাহাড়ি মানুষ! আহত হয়েছে ৫ শতাধিক। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন শতাধিক মানুষ।
হাতি ও মরেছে ৩২ টি! প্রসঙ্গত. প্রতিবছর ধান পাকার মৌসুমে ধান ও সবজি এবং আম-কাঁঠালের মৌসুমে আম-কাঁঠাল খাওয়ার নেশায় হাতির পাল নেমে আসে লোকালয়ে। চালায় তাণ্ডবলীলা। পাহাড়ী মানুষ ফসল ও বাড়ীঘর রক্ষার্থে হাতি তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠে। শুরু হয় হাতি-মানুষ যুদ্ধ! যুদ্ধে কখনো মানুষ প্রাণ হারায় কখনোবা হাতি! অপর দিকে বন্যহাতির তান্ডব থামাতে ইতোপূর্বে স্থাপন করা হয়েছে সৌরবিদ্যুৎচালিত তারের বেষ্টনী (ফেন্সিং), হাতির জন্য খাদ্যের বাগান তৈরিসহ হাতি ও মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়।
পাহাড়ি অঞ্চলে মাঝে-মধ্যে বন বিভাগ জনসচেতনামূলক সভাও করে। কিন্তু বন্যহাতির তান্ডব প্রতিরোধ করা যাচ্ছেনা। শেরপুরের সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে গারো পাহাড়ে হাতির আবাসস্থল। কিন্তু তৎকালীন অসাধু বন কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগসাজশে নগত নারায়ণের বিনিময়েই দরিদ্র লোকজন দখলে নিয়েছে এবং বসতবাড়ি গড়ে তুলেছে।
তাদের সাথে টাকার বিনিময়ে অলিখিত চুক্তিতে বাড়িঘর নির্মাণ, গাছপালা নিধন ও পাহাড় কেটে বন্ধ করে দিয়েছে বন্যহাতি ও জীব-জন্তু, জানোয়ারের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্র। এককালে পাহাড়ের চারপাশ ঘিরে ঝোপ-ঝাড়, ঘন-গহীন বন জঙ্গল সমৃদ্ধ ছিল। তখন শুধু হাতি নয় কোন বন্য জীব-জন্তু, জানোয়ারই লোকালয়ে আসেনি।
এখন পাহাড়ের সমতল ভূমিতে আবাদ করা আমন-বোরো, শাক-সবজি ও ফলমূলের খেতে নিয়মিতই নেমে আসছে হাতির পাল। সবই ধ্বংস করছে। খেয়ে সাবাড় করছে বাড়ির গোলার ধান। এজন্য অনেকেই আবাদ ছেড়ে দেয়ায় পতিত পড়ে রয়েছে বহু রেকর্ডিং আবাদি জমি দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে।
হাতি ঝর্ণা, নদীর পাড় বেয়ে এবং ব্রিজের নিচ দিয়ে পাকা ফসলের মাঠে নেমে আসছে। কখনো বা ভারত থেকে তাড়া দিয়ে এ পাড়ে ঠেলে দেয়া হয় হাতির পাল। আশির দশক থেকে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনে পাহাড়ের প্রাকৃতিক ভারসাম্যও বিনষ্ট হয়। হারিয়ে যায় বন্যপ্রাণী। থাকে শুধু বন্যহাতির তান্ডব। বন বিভাগ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঝিনাইগাতীর তাওয়াকুচা থেকে ছোট গজনী, হালচাটি এলাকা পর্যন্ত স্থাপন করে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ফেন্সিং। তাওয়াকুচা ও কর্ণঝোরা এলাকার ৫০ হেক্টর জমিতে করা হয় হাতির খাদ্যের বাগান। রাংটিয়া, গোপালপুর বিটে রোপণ করা হয় কাঁটাযুক্ত বেতগাছ গাছ। এতে ও কোন সুফল মেলেনি। সব কিছুই ভেস্তে গেছে।
এদিকে ক’দিন যেতে না যেতেই সোলার ফেন্সিং অকার্যকর হয়ে পড়ে। হাতির জন্য খাদ্যের বাগানও এখন নেই। ফলে হাতি খাদ্যের সন্ধাণে লোকালয়ে ঢ়ুকে চালাচ্ছে তান্ডব। হাতি ধান -কাঁঠালের প্রতি হাতি ব্যাপক দুর্বল। বন্যহাতি এক জায়গায় থাকতে পছন্দ করে না। আজ এখানেতো কালই অন্য খানে ছুটে যায়। এভাবেই চষে বেড়ায় গোটা গারো পাহাড়। প্রবীণ ব্যক্তিত্ব শতবর্ষী ডা. আব্দুল বারী, আলহাজ, সরোয়ারর্দী দুদু মন্ডল বলেন, একটি হাতির প্রতিদিন গড়ে ২০০ কেজি খাবার প্রয়োজন। পাহাড়ের ফলমূল, লতাগুল্ম, কলাগাছ ইত্যাদি হাতির প্রধান খাদ্য। কিন্তু পাহাড়ে এসব খাদ্যের অভাবে খাদ্যের সন্ধানে হাতির পাল লোকালয়ে নেমে আসছে। খেতের ফসল খেয়ে সাবাড় করছে। ভাংছে বাড়িঘর। খাচ্ছে গোলার ধান ও চালাচ্ছে তান্ডব। খেতের ফসল ও বাড়িঘর রক্ষার্থে লোকজন হাতি তাড়াতে গিয়ে বিঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না হাতির তান্ডব। রক্ষা পাচ্ছেনা পাহাড়ি হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী।
ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ফরহাদ হোসেন সবুজ বাংলাদেশকে বলেন, পাহাড়ের মানুষ এমনিতেই দরিদ্র। তাদের কষ্টার্জিত ফসল হাতি খেয়ে সাবাড় করায় কৃষকরা কষ্টে আছে।
ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, সরকার ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী গারো পাহাড়ে হাতি চলাচলের জন্য অভয়াশ্রম করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে হাতির উপদ্রব কমে যাবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে মানুষ ও যাতে না মরে, হাতিও যাতে না মরে সে জন্য।






