চট্টগ্রামে ধনীর দুলালরা শরীর পোড়াচ্ছে দামি আইসের ভয়ানক নেশায়

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি॥
ইয়াবার উপাদানে তৈরি শত গুণ বেশি ক্ষতিকর মাদকটির বিকিকিনি শুরু হয়েছে ইয়াবার মতোই। ঢাকার মতোই চট্টগ্রাম নগরীর ‘অভিজাত’ এলাকাগুলোতেও এখন চলছে মাদকটির রমরমা ব্যবহার, সঙ্গে ফুলেফেঁপে ওঠা ব্যবসাও। উচ্চমাত্রার উত্তেজক ও দামি এই ভয়াবহ মাদকটি মিয়ানমার থেকে চট্টগ্রাম হয়েই মূলত ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে।
বিত্তশালীরাই মূল ক্রেতা
বর্তমানে দেশে পাঁচ গ্রাম আইসের বাজারমূল্য প্রায় এক লাখ টাকা। বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় চট্টগ্রাম ও ঢাকার অভিজাত এলাকাগুলোতে এই মাদকের চাহিদা বেশি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর পর্যবেক্ষণ বলছে, বিত্তশালী পরিবারের সন্তানরাই মূলত আইসের মূল গ্রাহক। এর মধ্যে একটি অংশ তরুণীরা। অনেকে সিসা লাউঞ্ছগুলোতে গিয়েও এসব মাদক নিয়ে থাকেন। উচ্চমূল্যের ক্রিস্টাল মেথ বা আইস সেবন করা যায় সহজেই। ইয়াবার চেয়ে সহজে সেবন এবং ইয়াবার চেয়ে বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী নেশা হওয়ার কারণে মাদকসেবীদের কাছে এর কদর বাড়ছে।
এই মাদক অল্প সময়ের জন্য মানবদেহে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি করে। দীর্ঘ মেয়াদে মাদকটি সেবনে মাথার ভেতরের রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং হৃদ্রোগ, কিডনি ও যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আইস মূলত সরাসরি ইয়াবারই কাঁচামাল। তবে এটি ইয়াবার চেয়েও শতগুণ বেশি ক্ষতিকর। ইয়াবার অ্যামফিটামিনের সঙ্গে ক্যাফেইন থাকে। অন্যদিকে ক্রিস্টাল মেথ হচ্ছে সরাসরি অ্যামফিটামিন। ইয়াবায় এর ব্যবহার হয় ২০ শতাংশ। সেখানে আইস বা ক্রিস্টাল মেথে মিথাইল অ্যামফিটামিনের ব্যবহার শতভাগ। ১ গ্রাম আইস দিয়ে ৫০০ ইয়াবা তৈরি করা সম্ভব।

কিভাবে ঢোকে, কোথায় যায়
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের দেওয়া তথ্য মতে, থাইল্যান্ড থেকে মিয়ানমার হয়ে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভের নোয়াখালীপাড়ার সমুদ্র দিয়ে, হ্নীলার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এবং নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড়ি-সমতল এলাকা দিয়ে আইসের চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। টেকনাফ সীমান্ত ছাড়াও শাহপরীর দ্বীপ ঘোলারচর, দক্ষিণপাড়া সৈকত পয়েন্ট, মাঝের পাড়া, সাবরাং হারিয়াখালী, কচুবনিয়া, মুন্ডারডেইল, খুরের মুখ, সদর ইউনিয়নের মহেশখালিয়া পাড়া, বাহারছড়ার নোয়াখালী, শীলখালী, শামলাপুর, উখিয়ার ইমামের ডেইল, ইনানী, হিমছড়ি সৈকত পয়েন্ট দিয়ে আইসের চালান খালাস করা হয়ে থাকে।
তবে আইস বেশি আসছে সাগরপথেই। বিশেষ করে বিভিন্ন মাছ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে এসব আইস কক্সবাজারে ঢুকছে। নাফ নদী বা সাগরের মাঝপথে মাছ ব্যবসায়ীদের ট্রলারে তুলে দেওয়া হয় এই আইস। সাধারণত সাগরে মাছ ধরার পর সেই মাছ সংরক্ষণের জন্য জেলেরা বরফ ব্যবহার করেন। আইসও দেখতে একই রকম। এ কারণে মাছের নৌকা বা ট্রলারে করে তীরে আনার পর তেমন বেগ পেতে হয় না। গত জুলাইয়ে চট্টগ্রাম নগরীর ফিশারীঘাট ও ব্রিজঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার করা আইসের দুটি চালানের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃতরা জানান, মাছের আড়ালেই টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম আনা হয়েছিল মাদকগুলো।
সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিক্রেতারা সাধারণত মাদকটি কক্সবাজার থেকে কিনে চট্টগ্রাম নিয়ে আসে। এক্ষেত্রে কখনও কক্সবাজার, কখনও আবার বান্দরবান হয়ে সেগুলো চট্টগ্রাম ঢোকে। এর একটি অংশ চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকাগুলো টার্গেট করে বিক্রি করা হয়। এরপর বাকি মাদকগুলো ট্রাক বা অন্য কোনো মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লায় নিয়ে যাওয়া হয়। সর্বশেষ সেখান থেকে প্রাইভেটকারে কখনও গাজীপুর, কখনও মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় নিয়ে সেখানকার অভিজাত এলাকাগুলোতে বিক্রি করা হয়।
আইস নামের মাদকটি তৈরি হয় প্রধানত থাইল্যান্ডে। তবে মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারেও তৈরি হচ্ছে সাম্প্রতিককালে। এই তিনটি দেশ থেকে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশকে— এমন তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে একের পর এক চালান
গত ১০ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর লালদিঘীর পাড় এলাকা থেকে ৪৩ লাখ টাকা মূল্যের ৪৩০ গ্রাম আইসসহ চকরিয়ার বাসিন্দা নুরুল আবছার (৫২) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তবে চট্টগ্রামে আইসের প্রথম চালানটি ধরা পড়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন নগরীর খুলশী থানার মোজাফফরনগর বাই লেন থেকে ১৪ লাখ টাকা মূল্যের ১৪০ গ্রাম আইসসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। দুজনই দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম নগরীতে ‘ক্রিস্টাল আইস’ নামের নতুন মাদকটি বেচাকেনা করে আসছিল বলে জানিয়েছে র্যাব।
এরও আগে গত ২৫ মার্চ টেকনাফের উত্তর বরইতলী থেকে মো. হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে দুই কেজি আইসসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর ১৩ এপ্রিল টেকনাফ শীলখালী চেকপোস্টে তল্লাশি করে বিজিবি সদস্যরা ১৬৭ গ্রাম আইসসহ একজনকে গ্রেপ্তার করে।
এদিকে গত ১ মে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কলেজ গেট থেকে ২০০ গ্রাম আইসসহ আতাউল করিম নামে টেকনাফের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এর সাতদিন পর গত ৮ মে টেকনাফে উত্তর লম্বরী থেকে ১০০ গ্রাম আইস ও ১৪ হাজার ইয়াবাসহ ওসমান গণি নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই একই দিন টেকনাফের হ্নীলার নয়াপাড়ায় প্রায় এক কেজি আইসসহ হামিদ নামে এক রোহিঙ্গা তরুণকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গত ১৭ জুন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্জারটেক থেকে পাঁচ গ্রাম আইসসহ সাগর নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১২ জুলাই রাতে নগরীর ফিশারীঘাট এলাকা থেকে আইসের বড় চালান আটক করে র্যাব। ৯৭৫ গ্রামের চালানটির সাথে গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। এর দুদিন পর গত ১৪ জুলাই দিবাগত রাতে নগরীর ব্রিজঘাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৮০ গ্রাম ওজনের ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও পাঁচ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেটসহ তিন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশে প্রথম রাজধানীর জিগাতলার বাড়িতে হাসিব মুয়াম্মার রশিদ নামে এক যুবকের ল্যাবে পাঁচ গ্রাম আইস পায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

আস্ত পাহাড় গিলে খাচ্ছে সাগরিকা প্রিন্টার্সের আমজাদ!

ফরহাদ- চট্টগ্রাম :

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে পাহাড়। পাহাড় ভূমিকম্প থেকে রক্ষার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। আর এজন্যই বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে পাহাড় কাটাতো দূর সেখানে পরিবর্তন পরিবর্ধন করাটাও দন্ডনীয় অপরাধ। এবার চট্টগ্রামে সেই আইনকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পাহাড় কাটার মহোৎসবে মেতেছে সাগরিকা প্রিন্টার্সের মালিক আমজাদ নামক এক ব্যাক্তি। তিনি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর দায়িত্বে আছেন। আওয়ামীলীগ সরকারের অধীনে বেপরোয়া হয়ে উঠা এই ক্ষমতাধর ব্যক্তি ক্ষমতার ষোল আনাই যেন প্রয়োগ করে এখন গিলে খাচ্ছেন আস্ত এক পাহাড়। আর এতে করে একদিকে যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবেশ, অন্যদিকে ঠিক তেমনিই আবার প্রাণনাশের হুমকিতে পড়ছে সেখানে বসবাসকারী ভাড়াটিয়ারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরের আকবর শাহ্ থানার অন্তর্গত মীর আওলিয়া মাজারের পাশে অবস্থিত সাগরিকা প্রিন্টার্সের কোল ঘেষে মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে একটি সুবিশাল পাহাড়। অভিযোগ উঠেছে সেই পাহাড়টির ৪টি টিলা কেটে সেখানকার একটিতে স্থাপনা নির্মান করে সাগরিকা প্রিন্টার্সের মালিক আমজাদ। এছাড়াও আমজাদের নেতৃত্বে আরও তিনটি টিলা কেটে সেখানে স্থাপনা নির্মানের উপযুক্ত করে রাখা হচ্ছে। যদিও এখনও কাজের প্রায় অনেকটাই বাকী আছে। তবে আস্ত একটা পাহাড় যে এই পাহাড়খেকোর পেটে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে সেখানকার পরিস্থিতি। হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিতেও পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। হুমকিতে পড়ছে জীববৈচিত্র্য, ধ্বংস হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার পাহাড়ে বসবাসকারী এক ব্যাক্তি বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকেই আমজাদ সাহেবের লোকজন কোদাল, খন্তা দিয়ে পাহাড় কাটে। প্রায় তিন মাস যাবত প্রতিদিনই একটু একটু করে কাটছেন তার লোক। আমরা ভয়ে কিছু বলি না। শুনেছি তিনি নাকি এলাকার প্রভাবশালী লোক। থানায় উঠাবসা আছে তার। কিন্তু তিনি এই পাহাড় কাটার কারনে আমরা ভয়ে আছি। এখানে একাধিকবার পাহাড় ভেঙ্গে আমাদের টিনের চালের উপর পড়েছে। আমরা এর প্রতিকার চাই।

রুবেল হোসেন নামক স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, শুনেছি পাহাড়ের উপরে তিনি তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের একটি সুবিশাল কারখানা করবেন। আর এজন্যই সেখানে পাহাড় কেটে সমান করছেন। এর আগেও এখানে পরিবেশের অনেক লোক এসেছে কিন্তু কাউকেই কোন পদক্ষেপ নিতে দেখিনি।

পরিবেশবিদরা বলছেন, পাহাড় কাটার বর্তমান আইনটি সংশোধন করে কঠিন শাস্তির বিধান রেখে আইনটিকে সংস্কার করতে হবে। তবেই পাহাড় কাটা রোধ করা সম্ভব হবে। অন্যথায় পাহাড় কাটা বন্ধ করা না গেলে হুমকির মুখে পড়বে চট্টগ্রামসহ সারা দেশ। ভয়াবহ আকার ধারন করবে বন্যা, ক্ষয় হবে ভূমি, জলাবদ্ধতা নিরসন করা কখনোই সম্ভব হবে না। এ ছাড়াও পাহাড় কাটার ফলে প্রতিনিয়তই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে জানতে সাগরিকা প্রিন্টার্সের মালিক জনাব আমজাদের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ফলে উক্ত বিষয়ে বক্তব্য নেওয়াও সম্ভব হয়নি।

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম