
ডেস্ক রিপোর্টঃ মাহরীন চৌধুরীর বাবা মহিতুর রহমান চৌধুরী ২০১৪ সালে এবং মা ছাবেরা চৌধুরী ২০২০ সালে মারা যান। মাহরীন রাজধানীর শাইনপুকুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিতুমীর কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স শেষ করে মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করেন।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, মেহেরীনের শোকে কাঁদছেন সবাই। শিক্ষক হিসেবে আশপাশের সবাই তাঁকে চিনতেন। তাঁর মরদেহ দাফনের জন্য নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ি গ্রাম নিয়ে যাওয়া হয়েছে সোমবার রাতেই। সেখানেই দাফন হয়ে গেছে।
ওই বাসার বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, শিক্ষক মাহরীন অত্যন্ত মানবিক একজন মানুষ ছিলেন। সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন।
অভিভাবক মাহমুদা আক্তার বলেন, ম্যাডাম ছুটে এসেছেন, হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছেন শিক্ষার্থীদের। এমন সাহসিকতা আজকের দিনে বিরল। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিলেন– শিক্ষকতা কেবল পেশা নয়, এটা এক মহান ব্রত।
মাইলস্টোন কলেজের নিষেধাজ্ঞার কারণে এক শিক্ষিকা নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০০৬ সালে মেহেরীন মাইলস্টোন কলেজে যোগদান করেন। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার এক বছর পর যোগ দেন। পুরো কলেজে তিনি সহানুভূতিশীল শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
সোমবার, দুপুর ১টা ১৮ মিনিট। ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে হঠাৎ করেই আকাশ থেকে এসে পড়ল আগুনের গোলা। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিদ্যুৎ গতিতে বিধ্বস্ত হয় স্কুল প্রাঙ্গণে। সঙ্গে সঙ্গে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুনের লেলিহান শিখা। বিস্ফোরণে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করে শিক্ষার্থীরা। হাহাকার, আর্তচিৎকারে কেঁপে ওঠে চারপাশ। এই আতঙ্কের মুহূর্তে একা দাঁড়িয়ে যান একজন– তিনি শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী।
মায়ের মতো বুকের মাঝে শিক্ষার্থীদের আগলে রাখলেন। অথচ চাইলেই তিনি সরে যেতে পারতেন, বাঁচাতে পারতেন নিজের জীবন। কিন্তু তা তিনি করলেন না। নিজের জীবনকে আগুনের মুখে ঠেলে দিয়ে বারবার ফিরে গেলেন সেই শ্রেণিকক্ষে, যেখানে আটকে পড়েছিল তাঁর ‘বাচ্চারা’। একে একে টেনে বের করে আনেন কমপক্ষে ২০ শিক্ষার্থীকে। শরীরটাতে যখন আগুন লেগে যায়, তখন স্বামী মনছুর হেলাল ফোন দিলেন। তিনি বারবার তাদের দুই সন্তানের কথা ভেবে নিরাপদে সরে যেতে বলছিলেন। কিন্তু মাহরীন চৌধুরী স্বামীকে বলেছিলেন, ‘এরাও আমার বাচ্চা। তারা পুড়ে মারা যাচ্ছে, আমি কীভাবে সহ্য করি?’ এরপর বার্ন ইনস্টিটিউটে গিয়ে মেহেরীনের দগ্ধ শরীর পেলেন স্বামী। তাঁর শরীরের শতভাগই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। সোমবার রাতেই লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
মাহরীন চৌধুরী মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ী শাখার সমন্বয়ক ছিলেন। স্বামী ও দুই ছেলে মিয়াত চৌধুরী ও সাইফ চৌধুরীকে নিয়ে থাকতেন দিয়াবাড়ীতেই। স্বামী মনছুর প্রাইড গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক।
নীলফামারীতে থাকা মেহেরীনের স্বামী মনছুর হেলাল মোবাইল ফোনে কান্নাভেজা কণ্ঠে সমকালকে বলেন, আমি তাকে অনেকবার অনুরোধ করেছি নিরাপদে সরে যেতে। কিন্তু সে বারবার বলেছে, ‘ওরাও তো আমার বাচ্চা’। এই একটি বাক্যই তার জীবনদর্শন। আমি আর না করতে পারিনি। নিজের বাচ্চাদের এতিম করে চলে গেল! এখন আমি এ ছোট্ট সন্তানদের নিয়ে কীভাবে বাঁচব!
তিনি আরও জানান, হাসপাতালের বেডে শুয়েও মেহেরীন স্বামীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরো। অথচ সেই হাত পুরোপুরি আগুনে পুড়ে গেছে। স্বামী যখন জিজ্ঞেস করলেন, কেন এ কাজ করলে? মেহেরীন শুধু বলেছিলেন, ‘আমার সামনে আমার বাচ্চারা পুড়ে মারা যাচ্ছে– আমি কীভাবে সরে যেতে পারি!’
নীলফামারীর বগুলাগাড়ি গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়াতে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সেই স্কুলের অ্যাডহক কমিটির সভাপতির দায়িত্বও ছিল তাঁর কাঁধে। সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ফোনে নিয়মিত খোঁজ নিতেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের।
সর্বশেষ গত ২২ জুন গ্রামের স্কুলে গিয়ে একটি সভায় অংশ নিয়েছিলেন। পরের বার ২৮ জুলাই ফেরার কথা ছিল। তিনি ফিরলেন আপন ঘরে, আপন মাটিতে, তবে লাশ হয়ে।
গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টায় নিজের প্রতিষ্ঠিত বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে মেহেরীনকে বাবা-মায়ের কবরের পাশে শায়িত করা হয়। তখন ছিল আকাশ মেঘলা, বাতাস ভারি। এর আগে লাশবাহী গাড়ি যখন কলেজ চত্বরে প্রবেশ করে, চারদিক থেকে ছুটে আসেন গ্রামের মানুষ। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, প্রতিবেশী–সবাই। কেউ বলছিলেন, ‘ও আপা তো সবাইকে সাহায্য করতেন।’ কেউ কাঁদছিলেন– ‘এই কলেজ তো উনার স্বপ্ন।’
মেহেরীন চৌধুরী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খালাতো ভাই মহিতুর রহমানের মেয়ে। কিন্তু তিনি সেই পরিচয়ে নয়; মৃত্যুর পরও বেঁচে আছেন এক সাহসিকতার প্রতীক হয়ে। শিক্ষক, মা, যোদ্ধা– সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি সাহসের বাতিঘর।
মাইলস্টোন কলেজের পরিচালক রাসেল তালুকদার বলেন, যখন আগুন ধেয়ে আসছিল, সবাই প্রাণ বাঁচাতে ছুটছিল, তখন মেহেরীন চৌধুরী ছুটেছিলেন অন্যদের বাঁচাতে। নিজের জীবন দিয়ে তিনি অন্যের জীবন রক্ষা করেছেন। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন– শিক্ষক মানে শুধু পাঠদাতা নন। তিনি আশ্রয়, তিনি আলোকবর্তিকা। তিনি সাহসের নাম। আমরা কেবল তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করতে পারি না। তাঁর সাহসিকতা থেকে আমাদের শিখতে হবে– মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা।
প্রতিবেশী মাহমুদুর রহমান বলেন, দুই ঈদ ও মাঝেমধ্যে গ্রামে আসতেন মেহেরীন। এ সময় এলাকার গরিব মানুষকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন