সরকারি খাল দখল করে ভবন নির্মানের অভিযোগ সুধাংশু চৌধুরীর বিরুদ্ধে

স্টাফ রিপোর্টারঃ

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সরকারি খাল দখল করে গড়ে উঠা ভবন নিয়ে এলাকাবাসী স্বোচ্চার হলেও নীরব রাজউক, সিটি কর্পোরেশন সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও রাজউকের কারওয়ানবাজার জোনাল অফিসে মোঃ নুরল হুদা নামে এক ব্যক্তি সরকারী খাল দখল করে রাজউকের অনুমোদনহীন বিল্ডিং এর বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আবেদন করেছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ২ মার্চ ২০২৫ তারিখে ও রাজউকের কারওয়ানবাজার জোনাল অফিসে ১৮  মার্চ ২০২৫ তারিখে ৩৩৫ নাম্বার স্মারকে অভিযোগটি দাখিল করেছেন তিনি। অভিযোগে বলা হয়েছে বিগত সময়ে আওয়ামী দখলদারদের অপকর্ম এবং দখলদারিত্ব দেখেও চুপ থাকতে হয়েছে। বর্তমানে আওয়ামী ভূমিদস্যুদের থেকে সরকারি জায়গা পুনরুদ্ধারের সুযোগ এসেছে । মোহাম্মদপুরে লাউতলা ০৭ নাম্বার রোডে সুধাংশু চৌধুরী ওরফে রতন সরকারি খাল দখল করে দশ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন। এই ভবনটি ঢাকা সিটি জরিপ অনুসারে ঢাকা জেলার মোহাম্মদপুর থানার কাটাসুর মৌজার সরকারি ০১ নং খাস খতিয়ানের সরকারি খাল ভরাট করে খাস জমি দখল করে রাজউকের অনুমোদন না নিয়ে পেশিশক্তির দাপটে নির্মাণ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় এই এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি ও অগ্নি দূর্ঘটনা ঘটার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন এলাকাবাসী এর ফলে ব্যাপক প্রাণ হানির আশঙ্কাও করছেন তারা।

মোঃ নুরল হুদার অভিযোগের কাগজ গণমাধ্যমের হাতে আসলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদক মাহতাবুর রহমান এই বিষয়ে অনুসন্ধান করেন। রাজউক এবং দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বললে সিটি কর্পোরেশন বলছে রাজউকের কথা, রাজউক বলছে সিটি কর্পোরেশনের কথা। এমতাবস্থায় কেন উচ্চ আদালতে গিয়ে জনগনের সম্পদ রক্ষার্থে ও জনস্বার্থে মামলা করা হইবে না এই বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদক মাহতাবুর রহমান সরকারি ডাকযোগে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করেছেন।

এই সকল বিষয় নিয়ে সুধাংশু চৌধুরী কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ভবন আমার নয়, আমি এটার মালিক নয়।

সরকারি খাল দখল করে ভরাট পরবর্তী রাজউক অনুমোদন না নিয়ে বহুতল ভবন নির্মানের বিষয়ে রাজউক পরিচালক (জোন-৫) মোঃ হামিদুল ইসলাম বলেন বর্তমানে অবৈধ ভবন উচ্ছেদ অভিযান চলমান রয়েছে। আপনারাও আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন সরকারি জমি ও খাল উদ্ধারে আমাদের অভিযান চলমান আছে। আপনাদের দেয়া তথ্য নোট করলাম, সরকারি খাল অবশ্যই উদ্ধার করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি।

সরকারি খাস জমি অবৈধভাবে দখল বা কোনো অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করলে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। ভবন নির্মাণের অনুমোদন গ্রহণ না করা মূলত ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ এর ৩ (১) ধারা ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, ১৯৯৬ এর ৩ উপবিধির লঙ্ঘন। অনুমোদনের বাইরে ভবন করলে নির্মাণ আইন, ১৯৫২ এর ১২ ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তির সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে।

মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ সনের ৩৬ নং আইন, ৮(১) কোন ব্যক্তি এই আইনের কোন বিধান লঙ্ঘন করিলে অনধিক ৫ বছরের কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।

ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২১ এর ২২ ধারায় বলা হয়েছে যদি কোনো ব্যক্তি, সরকারি খাসজমি বা অন্য কোনো সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ভূমি বেআইনিভাবে দখল করেন বা উহাতে অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণ করেন, তাহা হইলে তাহার অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক দুই বৎসরের কারাদন্ড, বা অনধিক চার লক্ষ টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন। ইহা জামিন অযোগ্য অপরাধও বটে।

খুনিদের বিচার শুরু

স্টাফ রিপোর্টার:

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে হত্যাকারী শেখ হাসিনাসহ অন্য খুনিদের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শুরু হয়েছে এ বিচার। এ দিন পূর্বনির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী গ্রেফতারকৃত ১৩ আসামিকে হাজির করা হয়। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন আগামী ১৭ ডিসেম্বর।

এর মধ্যে শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুই মামলার তদন্ত সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

ধার্যকৃত তারিখ অনুযায়ী পৃথক দুটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৪৬ আসামিকে আদালতে হাজির করার কথা ছিল গতকাল। এর মধ্যে ১ নম্বর মামলার একমাত্র আসামি শেখ হাসিনাকে হাজির করা যায়নি। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের কাছে ট্রাইব্যুনাল জানতে চান, শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারের বিষয়ে অগ্রগতি কী? তিনি কোথায় আছেন? জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) পালিয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পেরেছে, তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় সরকার তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা তদন্তে দুই মাস সময় চায় তদন্ত সংস্থা। পরে আদালত এক মাস সময় মঞ্জুর করেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদন জমা দিতে বলেন। এ সময়ের মধ্যে ওয়ারেন্ট কার্যকর করতেও নির্দেশ দেয়া হয়।

এর আগে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যদিবসে সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে গারদখানা থেকে ১৩ আসামিকে এজলাসে তোলা হয়। আসামিদের মধ্যে ডা. দীপু মনিকে কাশিমপুর মহিলা কারাগার থেকে এনে হাজির করা হয়। বাকি ১২ আসামিকে হাজির করা হয় কেরানীগঞ্জস্থ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে। এ ছাড়া গ্রেফতারকৃত আসামি সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইল একটি মামলায় রিমান্ডে রয়েছেন মর্মে গতকাল হাজির করা যায়নি।

হাজির করা আসামিরা হলেনÑ সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, আওয়ামী লীগের জোট নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জোটের শরিক জাসদ (ইনু) নেতা হাসানুল হক ইনু, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্প-বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, হাসিনার জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম।
ট্রাইব্যুনাল প্রথমেই ‘আইটেম নম্বর-১’ হিসেবে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার মামলাটি হাতে নেন। এ সময় চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম দাঁড়িয়ে বলেন, আসামিপক্ষে সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী শুনানি করতে এসেছেন। তবে তিনি রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে যাচ্ছেন বলে জানতে পেরেছি। দুই-এক দিনের মধ্যেই হয়তো সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করবে। তাই তিনি আসামিপক্ষে শুনানি করলে এটি হবে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। এ সময় তাজুল ইসলাম তাকে আসামিপক্ষে শুনানি না করার অনুরোধ জানান।

এ সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান জানতে চান, এহসানুল হক সমাজী কোন্ আসামির পক্ষে এসেছেন। জবাবে সমাজী পাঁচ আসামির নাম বলেন। তারা হলেনÑ সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, তৌফিক-ই-এলাহী, মুহাম্মদ ফারুক খান ও জুনায়েদ আহমেদ পলক। এ সময় তিনি শুনানি না করে আরেক আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলুকে দায়িত্ব দেন।

সমাজী ট্রাইব্যুনালকে বলেন, আমি এখনো ফরমাল কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাইনি। ফরমাল লেটার পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। এ ছাড়া যে পদ আমাকে দেয়া হবে সেটি আমি গ্রহণ করি কি না তাও ভাববার বিষয়। পরে এহসানুল হক সমাজী বিষয়টি নিয়ে যেহেতু বিতর্ক উঠেছে তাই ওই দিনের মতো আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা থেকে বিরত থাকেন।

পরে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম মামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের সম্পৃক্ততা, দায়-দায়িত্ব তুলে ধরেন। সাড়ে ১৬ বছরের নিষ্ঠুর শাসনামলের সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি তুলে তাজুল ইসলাম এ সময়কে ‘ফ্যাসিবাদের দুঃশাসন’ হিসেবে অভিহিত করেন। এর মধ্যে গুম, খুন, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ, বিচার বিভাগকে ব্যবহারসহ নানা বিষয় ছিল। এরপর গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের তথ্য তুলে ধরেন। কীভাবে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা, গুলি চালানো হয়, গণহত্যা চালানো হয় তা উল্লেখ করেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে উৎখাতের পথ সুগম ছিল না। দেড় হাজার মানুষের প্রাণ, ২৫ হাজার আহতের মাধ্যমে সর্বগ্রাসী শাসন থেকে ন্যায়পরায়ণ দেশ পেয়েছি। জেন-জির চূড়ান্ত আত্মত্যাগে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি।

গণহত্যা এবং মামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরার পর ট্রাইব্যুনাল চিফ প্রসিকিউটরের কাছে জানতে চান, মানতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে হাজিরকৃত ১৩ ব্যক্তি কিভাবে সম্পৃক্ত। জবাবে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, তারা (অপরাধ সংঘটনের) নির্দেশ দিয়েছেন। পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, সরাসরিও জড়িত ছিলেন, সহযোগিতা করেছেন। স্বরাষ্ট্রসচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন নির্দেশনা দেয়াতে। অপরাধের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্তার প্রমাণস্বরূপ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, ফটো, ভিডিও, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন পোস্ট, কমেন্ট ও ভিডিও ফুটেজ তদন্ত সংস্থা খুঁজে পেয়েছে।

মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দেয়া, প্ল্যানিংয়ের সাথে থাকা, শক্তি থাকা সত্ত্বেও অপরাধ প্রতিহত না করা, অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শাস্তি না দেয়া, প্রিভেন্ট করার চেষ্টা না করাÑ এর সবগুলোই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে শুরু হয় স্বৈরাচারী আচরণ। বিরোধীদের দমন, গুম, খুন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া, ভিন্নমত পোষণকারীদের নিপীড়ন করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে নেয়া হয়। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সরকার গঠন করে। ২০১৮ সালে বিএনপি অংশ নিলে কারচুপি, দিনের ভোট রাতে করে। ২০২৪ সালে ‘আমি আর ডামি’ নীতি অনুসরণ করে নির্বাচন করে জোর করে ক্ষমতায় বসেন। ফ্যাসিবাদের সাড়ে ১৬ বছরে হাসিনার নেতৃত্বে হত্যা, গুম, হেফাজতে ইসলামের ওপর হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটে। প্রহসনের বিচার চলত। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর বন্দি রাখা হতো। যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পায়। গত ১৫ বছরে ৬১১ জনকে গুম করা হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি, অর্থপাচারের ঘটনা ঘটে। দুই লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শেয়ারবাজার থেকে লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। ‘রাজাকার’ শব্দ ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা হতো। এসবের কারণে মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাঁধে। মানুষ একটি সুযোগ খুঁজছিল। কোটা আন্দোলন পরে গণআন্দোলনে রূপ নেয়।

তাজুল ইসলাম বলেন, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর মতো মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন শেখ হাসিনা। শুধু জুলাই-আগস্ট মাসের হত্যাকাণ্ডই নয়, বিগত সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই গুম-খুন ও হত্যার বীভৎসতা সৃষ্টি করে। হিটলারের সময়ের গোপন নির্যাতন প্রকোষ্ঠ তৈরি করে তাতে নিষ্ঠুরভাবে বন্দিদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। তারা শুধু গণহত্যাই করেনি, নির্যাতনের যত রকম পন্থা রয়েছে সবই বাস্তবায়ন করেছে। যা হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কথা মনে করিয়ে দেয়।

ট্রাইব্যুনালের বাইরে তাজুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারে যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, তাদের মধ্যকার ১৩ জনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়েছে। আগামী দিনে যারা ফ্যাসিস্ট হতে চান, তাদের জন্য আজকের দিনটি একটি শিক্ষার দিন। মানবতাবিরোধী অপরাধ করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকা যায় না, বিচারের মুখোমুখি হতে হয় তা আজকের দিনের এক বড় শিক্ষা।

তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতিকরণ, দলীয়করণের মাধ্যমে একটি নিপীড়ক সংস্থায় পরিণত করা হয়েছিল, সে স্টোরি আমরা আদালতে তুলে ধরেছি। একটি মাত্র পরিবারকে ক্ষমতায় রাখার উদ্দেশ্যে পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। একটি দলকে বছরের পর বছর ক্ষমতায় রাখতে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আজকে যে ১৩ জনকে গ্রেফতার করে হাজির করা হয়েছে তাদের অপরাধ এতই জঘন্য যে, শুধু শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে গণহত্যা চালাতে দ্বিধা করেননি। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য গোটা জাতিকেও হত্যা করতে তারা দ্বিধা করত না। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ‘আমি আর ডামি’ নীতিতে নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করেন শেখ হাসিনা।

ট্রাইব্যুনালে তাজুল ইসলাম বলেন, কোটা আন্দোলন ঢাকা থেকে শুরু হয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। রংপুরে আবু সাঈদ প্রথম শহীদ হন। একই দিনে আরো পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। ৫ আগস্ট ‘ঢাকা মার্চ’-এর ডাক আসে। ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যান। তারপরও তার নেতাকর্মীরা ওই দিন গভীর রাত পর্যন্ত গণহত্যা চালায়। ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ১৩ আসামিসহ অন্যরা তিন বাহিনীর ওপর চাপ অব্যাহত রাখে যেন তাদের ক্ষমতায় রাখা যায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শতাধিক শিশু হত্যার শিকার হয়। দেড় সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়। ঘরে থাকা শিশুদেরকেও হত্যা করা হয়। এক ব্যক্তিকে (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় রাখতে গোটা জাতিকে হত্যা করতে তারা দ্বিধা করেনি। তাদের বিষয়েও তদন্ত শেষ করতে দুই মাস সময় প্রয়োজন। পরে ট্রাইব্যুনাল তদন্ত সম্পন্ন করতে এক মাস সময় দেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বর পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর শুনানি করেন। এ সময় অতিরিক্ত প্রসিকিউটর মীজানুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম ও বি এম সুলতান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
‘আয়নাঘর’-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর ট্র্রাইব্যুনালের বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, বিগত সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্যাম্পে নিয়ে গুম, খুনের ঘটনা তারা ঘটিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনীর ক্যাম্পগুলোর সঙ্গে তুলনীয় ছিল বিগত সরকারের গুম-খুনের ঘটনা। তারা শুধু যে গণহত্যা করেছে শুধু তাই নয়।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, প্রথম মামলার এক নম্বর আসামি শেখ হাসিনা। তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে ফরমাল আবেদন পাঠিয়েছি ইন্টারপোলের কাছে। রেড নোটিশের মাধ্যমে তাকে পেলে যেন গ্রেফতার করা হয়। তবে এর বাইরেও পদক্ষেপ রয়েছে। যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি আছে। ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত যে চুক্তি তার মূলে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার চিন্তা করছে বলে রোববার প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে বলেছেন। সুতরাং সেই প্রক্রিয়ায়ও বাংলাদেশ যাচ্ছে। এটি আমরা ট্রাইব্যুনালকে জানিয়েছি।

তিনি জানান, ডিফেন্সের পক্ষে বেশ কয়েকজন আইনজীবী তাদের ওকালতনামা দাখিল করেছেন। তবে তাদের পক্ষ থেকে শুধু একজনের জন্য পিটিশন ছিল। সেই পিটিশনটি ছিল অভিযোগের কপি সরবরাহ করা সংক্রান্ত। কিন্তু পিটিশনটি যথানিয়মে দাখিল করা হয়নি। সুতারাং পিটিশন হিসেবে সেটি গণ্য হয়নি। ভবিষ্যতে তিনি যদি মনে করেন সেটির ব্যাপারে আদালত যথাযথ আদেশ দেবেন।

এর আগে গত ১৭ অক্টোবর পৃথক দুই আবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর মধ্যে শেখ হাসিনা ছাড়াও তার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিম, তার দুই ভাতিজা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ রয়েছেন।

এছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় সাবেক সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ. আরাফাতের বিরুদ্ধে। পৃথক আরেকটি আবেদনের প্রেক্ষিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানসহ ছয়জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়।

জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বহুল প্রত্যাশিত বিচারের প্রথম দিন সকাল ১০টায় দুটি প্রিজন ভ্যানে করে ১৩ আসামিকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। দীপু মনি ব্যতীত ১২ জনকে ট্রাইব্যুনালের ১২২ নং কক্ষে রাখা হয়। দীপু মনিকে রাখা হয় অন্য কক্ষে। ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে আসামিদের এজলাসে আনা হয়। সেখানে আসামিদের বসার জন্য ডকে চেয়ার রাখা ছিল। ডকে থাকা আসামিদের মধ্যে হাসানুল হক ইনু, বিচারপতি মানিককে স্বাভাবিক দেখা যায়। সালমান এফ রহমান তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। দীপু মনি অধিকাংশ সময় গালে হাত দিয়ে দুশ্চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। তিনি তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর সঙ্গে বারবার কথা বলছিলেন। ট্রাইব্যুনাল চলাকালে কামাল আহমেদ মজুমদার তিন-চারবার দাঁড়িয়ে ‘মাননীয় আদালত’ বলে বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। পুলিশ তাকে থামিয়ে দেয়।

 

সবা:স:জু-১৩৯/২৪

 

ভাষা পরিবর্তন করুন »
সংবাদ শিরোনাম